শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৯

রাত্রী বিলাস( ফেনীর রাস্তায় এক রাত্রী) : জাকির রুবেল

সেদিন রাত্তিরে ফিরতে একটু দেরিই হয়েছিল। স্যার কয়েকজনের সাথে জমিয়ে আড্ডা মারতে মারতে কখন যে বরোটা বেজে গেল বুঝতেই পারিনি। এগারোটাই বাসার গেইট ক্লোজ করে দেন বাসার মালিক নবাব......। ফেনী শহরের বাসার মালিকরা এক একজন নবাব। বাসাগুলো এক একটা জেলখানা। গেইটে দারোয়ানও রাখবেন না আবার ভাড়াটেকে চাবিও দিবেননা। সকালে নামাযের জন্য উঠলে বাসার মালিকের কাছে চাবির জন্য যেতে মনে হয় বড় কোন অপরাধ করে জর্জের সামনে যাওয়া। সে জন্য ফজর নামাযটা বাসায়ই পড়া হয়।

বাসায় অাজ কেও না থাকায় আর বাসায় ঢুকতে মন চাচ্ছেনা। মাথায় অন্য একটা প্লান কাজ করছে। সারারাত বাইরে কাটালে কেমন হয়?রাতের ফেনী দেখতে কেমন তা দেখার সখ ছিল অনেক অাগ থেকেই।  আগামীকাল শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। সারাদিন ঘুমিয়ে রাতের ঘুম পুসিয়ে দেয়া যাবে। শীতের রাত, চারিদিকে ঘন কুয়াশা। ভাগ্যিস চাদরটা নিয়েই বেরিয়ে ছিলাম। কুয়াশায় ল্যাম্প পোস্টের ল্যাম্পগুলোই শুধু অালোকিত বাকি চারপাশ দেখাই যাচ্ছেনা। যেই ভাবা সেই কাজ। হঠাৎ বউয়ের ফোন - কি কর?  আমি বললাম "ঘুম পাচ্ছে রাখো জানু, সকালে কথা বলবো "। এই বলে ফোন রাখলাম। কারন এত রাতে বাইরে ঘুরার কথা বললে বউয়ের বকা খেতে হবে নিশ্চিত। হাদীসে অাছে নাকি বউয়ের সাথে ছোটখাটো মিথ্যা কথা বলা জায়েজ অাছে।

এনা কাউন্টার থেকে সোজা হাটা ধরলাম মহিপালের উদ্দেশ্যে। হাটলে দু'মিনিটের রাস্তা। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম আস্তে আস্তে হরটে যাবো। কিছুদুর এগুতেই একটা বুড়ো রিক্সাওয়ালা এসে বললো যাবেন?  আমি গাড় নেড়ে না বললাম। আবার হাটা ধরলাম৷ ঘড়িতে দেখি ১২ঃ৩০ মি।রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে দুএকটা মাইক্রো সাই করে চলে যাচ্ছে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে। মাথায় একটা গান বাজতেছে। গাইবো কি গাইবোনা এই দোটানায় অাছি। আমরা শিক্ষক মানুষ। মাঝরাতর রাস্তায় জোরে গান করা উচিত না। গানের কথা মনে হতে মনে পড়লো দাদার কথা। দাদা বলতেন রাতে ভূত পেতের ভয়ে নাকি একাকী পথিকেরা জোরে জোরে গান গাইতো।
আমি আবার ভূতে বিশ্বাস করিনা।

ভূতের কথা মনে হতেই মনে পড়লো বন্ধু সিরাজের কথা। আমাদের বন্ধুদের মাঝে একটু ভবঘুরে টাইপের ছেলে সে। ছোটবেলায় রাস্তায় চলতে তার হাতে থাকতো একটা ছোট্ট রেডিও। আমাদের তখন ভূতে ভয় থাকলেও তার সেরকম কোন ভয় ছিলনা। সে রাত বিরোতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো। সেই আমার ভুত না বিশ্বাস করার গুরু। যাক! হাটতে হাটতে মহিপাল এসে পৌচলাম। ফ্লাইওভারটা স্বগৌরবে দাড়িয়ে অাছে আওয়ামীলীগের উন্নয়ের স্বাক্ষী হিসেবে। যদিও ফ্লাইওভার হওয়ার পরেো জ্যাম কমেনি। ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়ালাম। এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। কিছু লোক ময়লা কাথা গায়ে শুয়ে আছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশকে দেখলাম। রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে থামিয়ে হাদিয়া নিচ্ছেন। দাড়িয়ে কিছুক্ষন তাদের সেই হাদিয়া নেয়ার দৃশ্যটা উপভোগ করছিলাম। একজন ট্রাফিক পুলিশ আমার কাছে এসে জানতে চাইলেন, নাম পরিচয়, কথায় যাবো কি কি কি ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্য কথাটা বলে দিলাম যে চাবির জন্য বাসায় ঢুকতে পারছিনা তাই হাটতে বের হলাম। পুলিশ মসায় কিছু না বলে একগাল হাসলেন।

সামনে দক্ষিনে কিছুদূর এগোলাম। দেখলাম ফ্লাইওভারের নিচে দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে অাছে। একটা মাঝবয়সী ছেলের সাথে ঝগড়া হচ্ছে। কিসের যেন টাকা নিয়ে। আরো কাছে এগুতেই বুঝতে পারলাম ওরা দেহ প্রসারনী।রাতের মনি মনসা। ছেলটা ব্যবহার করে টাকা দিচ্ছেনা। তাই ঝগড়া। মহিলাটি যাচ্ছেতাই রকমের বাজে বাজে গালি দিচ্ছিল। পরে ছেলেটা ১০০ টাকার একটা নোট মহিলাটির গায়ে ছুড়ে দিয়ে হন হন করে পশ্চিম দিকে হাটা ধরলো। আর বিড় বিড় করে বলতে লাগলো মাগী........।মহিলাটিও বলতে লাগলো "চু.......বি অার টাকা দিবিনা হারামী বাচ্ছা, মাগীর পুত.......। আরেকবার টাকা ছাড়া আসলে.... কাটি রাখি দিমু.....।

কানে এসব অস্রাব্য গালী শুনে মনটা কেমন যেন বিশ্রী পরিবেশে ঘুরে গেল। যাক, আরো কিছুদুর সামনে এগুলাম। গত পরশু দিনে যে ভিক্ষুককে দেখলাম তার অন্ধ মেয়ের জন্য টাকা তুলছিলো আজ রাস্তায় তাকেই দেখলাম মেয়েটার উপরে উঠে অাছে। এ কোন অাজব খেলা। মাওলাই ভালো জানে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো 'অসভ্য'! ফ্লাইওভারের উপরে উঠবো বলে পা বাড়ালাম। ল্যাম্প পোস্টে আলো দুই সারিতে। ইউরোপ অামেরিকার মত দৃশ্য,এ যেন অঙ্কিত ছবি! দেশের একমাত্র ৬ লেন বিশিষ্ট ফ্লাইওভার এটি। সরকারের উন্নয়নের একটি বড় বিজ্ঞাপন।
ভালোই লাগছে। ঘন কুয়াশা চারদিকে। পরিবেশটা অসাধারন। ফ্লাইওভারের ঠিক মাঝ বরাবর এসে পূর্বে দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। সারাদিনের সেই ব্যাস্ত রাস্তা এখন একেবারেই ফাঁকা। চারদিকে নিশ্চুপ নিরবতা। সামনে একটা বিশাল বিলবোর্ড। কন্ডমের বিজ্ঞাপন "আসল পুরুষ " স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে অাছে। বামে অারেকটা বড় ব্যানার "মহিপাল হারবাল " এক ফাইলে যথেষ্ট।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় ১ঃ২০ মি। পেচনে পিরতেই একটি পাগলীকে দেখলাম। চমকে উঠলাম তাকে দেখে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে অাছে। মুখে কি যেন বলছে বুঝতে পারছিনা। মনের মাঝে শিরশিরে অনুভবের হালকা ভয় খেলে গেল। জানি ভুত বলে কিছু নেই। তবুও হালকা ভয় পাচ্ছি। কি মনে করে হঠাৎ তার হাতে ২০ টাকর একটা নোট গুজে দিতেই দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলো হাসতে হাসতে। বুকটা তখনো দড়ফড় দড়ফড় করছে। পাগলীর হলুদ দাঁতের হাসি ও ঝট চুলগুলো চোখের সামনে ভাসছে। ভালো লাগছেনা আর। নিচে নেমে এলাম ফ্লাইওবার থেকে। নিচে একটা রিক্সা দাঁড়ানো। ভাই যাবেন?
-"হ যামু।
-কই যাবেন বলেন?
-"আপনাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরবো। সারারাত কত নিবেন?"
মাঝবয়সি লোকটার মুখে হাসির রেখা দেখা দিলো। উত্তরে বললো
-"দিয়েন ইনসাফ করি "
উঠে বসলাম রিকসায়। রিকসা ট্র্যাংক রোড়ের দিকে এগিয়ে চলছে। রিক্সাওয়ালা লোকটাকে রসিকই মনে হলো। তিনি মমতাজের একটা গান ধরলেন " ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়.... বন্ধু,যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া....।
আঞ্চলিকতার ভাবে মনে হলো লোকটি নোয়াখীর। জিগাইলাম -
- "চাচা বাড়ি কই "
-নোয়াখালী সোনাপুর বাজরের পূর্ব পাশে।
এখানে কই থাকেন?
-সহদেবপুর, এক ছেলে দুই মেয়ে। আর আপনেগো বউ থাকে।
ভালো ভালো। তো অারেকটা গান ধরেন না?
এবার একটু জোর গলাই গানটা ধরলেন চাচু।
"ওরে নীল ধরিয়া............. আমায় দেরে....... আমিও চাচার সাথে ঠোট নাড়তেছি।
পুরনো দিনের গানগুলো হৃদয়ে সর্বদাই নাড়া দেয়।

রিক্সা চলছে হনহনিয়ে, গান গাইতেছি গুনগুনিয়ে। হঠাৎ কানে গালিগালাজের শব্দ শুনতে পেলাম। পাশে ২০/২২ বছরের একটা যুবক ছেলে। হাতে একটা বোতল। মেদর বোতলই হবে হয়তো। মদ খাচ্ছে অার গাল দিচ্ছে। হঠাৎ যুবকটি দেখলাম একটা বৈদ্যুতিক খুটিকে জড়িযে ধরে বলতেছে " বাবা আমায় মাপ করে দাও, বাবা বাবা বাবা বলে চিৎকার করছে। ততক্ষনে অামরা পুলিশ ফাঁড়ি পেচনে পেলে সামনে এগিয়ে গেল।। মুখ থেকে ছেলেটার জন্য"উফ" শব্দটি বেরিয়ে গেলো। কত ছেলের জীবনটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে এই মাদকের ছোবলে তার ইয়ত্তা নেই।তরুনদের ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে।

(চলবে............................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন