এই ছবিটা কার?
-ইনি মায়ের কলেজ মেট।
-উঁহু। ছবির মেয়েটা আমার বান্ধবী নয়। আমি একে কোনওদিন দেখিইনি।
মায়ের কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম। বিয়ের মাসখানেক হয়েছে। নতুন বউ আলমারি থেকে বের করেছে পারিবারিক অ্যালবামগুচ্ছ। পাশে বসে আমি। বাবা-মায়ের বিয়ের ছবি, প্রথমবার ভ্রমন, আমার নাম রাখার অনুষ্ঠান, আমার খৎনার অনুষ্ঠানের ছবি... পাতার পর পাতা জুড়ে কত কত বছরের সালতামামি।
তার মাঝেই এই ছবিটা। একটা মেয়ে বসে আছে টেবিলের ওপরে কনুই রেখে। পাশে রাখা ফুলের টব। ছোটোবেলা থেকে তো এঁকে মায়ের বান্ধবী বলেই জানি!
মায়ের মুখে মৃদু হাসির রেখা। তূর্ণার মুখেও মজা পাওয়ার হাসি, ‘কী ব্যাপার মা? কোনও ক্যামিস্ট্রি আছে মনে হচ্ছে!’
মা আলতো হেসে অ্যালবাম থেকে ছবিটা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ছবির পিছন দিকটা দ্যাখ একবার।’
দেখলাম। পুরোনো দিনের কালির কলমে লেখা। বিএ, বাংলা, প্রথম বর্ষ। তার নীচে তারিখ দেওয়া। ১/৭/১৯৮৮ইং। কিন্তু এর মধ্যে রহস্যটা কোথায়?
-হাতের লেখাটা চিনতে পারছিস না?
চেনা চেনা লাগছিল। মা বলতেই চকিতে চিনে ফেললাম। এটা তো বাবার হাতের লেখা! পরবর্তী সময়ে হাতের লেখা বদলালেও লেখার ছাঁদ চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না।
মা ছবিটা অ্যালবামে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘যা ভাবছিস তাই। অনামিকা ছিল তোর বাবার বান্ধবী। তোর বাবা একেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়ের বাবা সরকারী চাকুরে ছাড়া দেবেন না, তাই আর...’
দেওয়ালে ঝোলানো বাবার ছবিটার দিকে তাকালাম। ঘুমের মধ্যে হওয়া ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কয়েক মাস আগের ছবি এটা। ভারী পাওয়ারের চশমা। গম্ভীর মুখে জোর করে আনা সামান্য হাসির ছাপ। বাবা নেই দু-বছর হতে চলল। তাই বাবা বললে এই ছবিটাই আজকাল ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। কিন্তু মা যে বাবার কথা বলছে সে অন্য মানুষ।১৯৮৮ সালে বাবার বয়স কত ছিল? হিসেব করলাম। তিরিশ।
মা ছবিটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলছিল, ‘তোর বাবা আমাকে বিয়ের পরপরই জানিয়েছিল সব। কিন্তু ছবিটা দেখায়নি। ঘর গোছাতে গিয়ে আমি এটা খুঁজে পাই, পুরোনো একটা ডায়রির ভেতর। তখন তোর বছরখানেক বয়স। আমিই এটা অ্যালবামে রেখে দিয়েছিলাম। বলে দিয়েছিলাম, ছবিটা অ্যালবামেই রাখছি। সব ছবির সঙ্গে। না হলে হারিয়ে যাবে। তোর বাবা কোনও আপত্তি করেনি।’
মায়ের কথা বলার সহজ ভঙ্গি থেকে স্পষ্ট, হারানো প্রেম বাবার জীবনে আর কখনও উঁকি মারেনি। কেবল একটা সাদা-কালো ছবি হয়ে সেঁধিয়ে গিয়েছিল অ্যালবামের পাতায়।
তূর্ণা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ! আপনি চেয়েছিলেন যাতে ছবিটা হারিয়ে না যায়?’
‘হারিয়ে গেলেই তো মানুষ তাকে হাতড়ে বেড়ায় এদিক সেদিক। তার চেয়ে হাতের কাছেই থাক। চাইলেই দেখতে পাব, এটা ভাবতে ভাবতে দেখার আকুতিটা কমে যায়।’
সত্যিই কমেছিল? বাবা কি কোনওদিন মাকে লুকিয়ে চোখ রাখেনি পুরোনো বান্ধবীর ছবিতে! নাকি মা-র কথাই সত্যি? কে জানে। আর তো কোনওদিন জানা যাবে না। তবে এটা বাবা-মা দুজনেই জানত, অ্যালবামে রাখা হোক বা না হোক, এই সাদা-কালো তরুণী আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে থেকে যাবেন, আজীবন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন