বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১৮

শিক্ষক ও শিক্ষা নিয়ে হৃদয়েছাঁয়া একটি গল্প

গল্পটি প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্যার এর অনার্জিত শিক্ষাপুরাণ বই থেকে নেয়া। সরল ভাষায় শিক্ষার স্বরূপ, শিক্ষকের অবয়ব নিয়ে শতাব্দীকাল আগের একটি গল্প বলেছেন। বহুবারই পড়েছি, নতুন করে আবার পড়তে শুরু করলে আগের চেয়ে বেশী আগ্রহ নিয়ে শেষ করতেই হয়। আপনাদেরও ভাল লাগতে পারে।

ভারতের গুজরাট জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক শিক্ষামনস্ক ব্যক্তি যিনি উনিশ শতকের শুরুতে ওকালতি শুরু করেন। দ্বার পরিগ্রহ করেন তার পরে। একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পুত্রস্নেহ তাকে ভাবতে শুরু করায়, এ সন্তান কি করে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। তিনি ওকালতি ছেড়ে ১৯১৬ সালে প্রাদেশিক শিক্ষা ডিরেক্টরের অফিসে গিয়ে প্রাথমিক স্কুলে একটি চাকুরির আবেদন করেন। তিনি বেশি শিক্ষিত। শিক্ষকতার কোন অভিজ্ঞতা নেই এবং শিক্ষা বিষয়ে কোন ট্রেনিং নেই বলে তার চাকুরি হলো না। তার আগ্রহ দেখে ইংরেজ সাহেব তাকে একটি বেসরকারি স্কুলে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। এ সুযোগে গিজুভাই ভাদেকা একটি শর্ত জুড়ে দিলেন যে তিনি তার মতো করে পড়াতে চান এতে যেন বাধা দেয়া না হয়। সাহেব বললেন ঠিক আছে কিন্তু ঐ ক্লাশে যা শিখবার তা শেখা হয়েছে কিনা তার পরীক্ষা নেয়া হবে। ভাদেকা বললেন তার আপত্তি নেই তবে শর্ত পরীক্ষা সাহেব নিজে নেবেন। নিয়োগপত্র নিয়ে তিনি স্কুলে উপস্থিত। স্কুল প্রধানের চক্ষুস্থির। প্রথমত: তিনি শিক্ষক চাননি। দ্বিতীয়ত: একটি ক্লাসের দায়িত্ব মূলত তাকেই দিতে হবে। তৃতীয়ত: তার শিখন-পড়ন পদ্ধতিতে যেন বাধা না দেয়া হয়। সাহেবের চিঠি তিনি মান্য করলেন তবুও বললেন তার জন্য যেন অন্য ক্লাস, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও পাড়া-প্রতিবেশীর নালিশ তাকে শুনতে না হয়। নতুন শিক্ষক বিনয়ের সাথে সবই মেনে নিলেন। শুধু অন্যের নালিশ বন্ধ করা সম্ভব নাও হতে পারে, কারণ ছাত্রদের আগ্রহ সৃষ্টিই তার কাজ, তার সৃজনশীলতাকে উস্কেদেয়াই তার রীতি, তাদের শাসন করা তার পদ্ধতি নয়; তিনি শিক্ষার অভিযাত্রায় তাদের সঙ্গী মাত্র, হয়তো বা পথের কাঁটা সরিয়ে দেবার কর্মটি তার, তার বেশি কিছু নয়। প্রধান শিক্ষক চিন্তিত হলেন সঙ্গত কারণে। তাকে সাথে নিয়ে তার জন্য চতুর্থ শ্রেণীর নতুন শাখা চিহ্নিত করে দিয়ে বললেন, কাল থেকে ক্লাস শুরু হবে।

নতুন শিক্ষক বাড়ি ফিরে এলেন। তার কানে বাজতে থাকল প্রধান শিক্ষকের কথা, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদান সহজ কাজ নয়, আর মনে রাখবেন পাঠ্যপুস্তক আছে, পাঠক্রম নির্দিষ্ট আছে, শিক্ষাদান সহায়িকা আছে,পাঠ্যক্রম তৈরি করাবার পদ্ধতি আছে, পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময় আছে, ভালো ছাত্রকে উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয়তা আছে, কারণ বৃত্তি পেয়ে সেই তো স্কুলের মান রাখবে, আপনি এসব ভন্ডুল করবেন না। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম বিধিও আছে। পাঠ্যপুস্তক দেখে নবীন শিক্ষকের হতভম্ব হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পাঠক্রমের মধ্যে নানা বিষয়ের সংমিশ্রণ তিনি দেখলেন। দেখলেন অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, কিন্তু শিক্ষার্থীর মনকে আকর্ষণ করে তেমন বিশেষ কিছু তো নেই। তরুণ মন তো উর্বর ভূমির মতো। সেখানে জীবনের আদর্শ, মূল্যবোধ. সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা সবই তো আনতে হবে এমনভাবে, যাতে সে এগুলোকে দায়ভার মনে না করে; আনন্দের আবহ যদি জ্ঞানের বাহন না হয়, তাহলে নিরস শিক্ষা তো আত্মবিসৃত হওয়ার পথ মাত্র। ছাত্রদের ভালো খারাপ বলে বিন্যাস করে নিলে তাদের যে ঐক্য এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এটাই বা সৃষ্টি হবে কি করে? নবীন শিক্ষকের এমন সব দুশ্চিন্তা তাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখল । তবুও মনে মনে তিনি পরের দিন কীভাবে ক্লাস সাজাবেন, পাঠ দেবেন তার একটা ছক কেটে নিলেন।

সকালে সময়ের অনেক আগে স্কুলে পৌছলেন। দরজা খোলা নাই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত। ছাত্ররা আসছে মলিন কাপড় পড়ে হট্টগোল করতে করতে। পিয়ন স্কুল প্রধানের বাড়ি থেকে চাবি এনে ক্লাস খুলে দিল। চেয়ার টেবিল বেঞ্চ কিছু ঝাড়া হলো না। জানালায় ছাদে মাকড়সার ঝুল। ঘন্টা বাজল সময় মতো। নবীন শিক্ষক ক্লাসে গেলেন। কেউ তাকে দেখে হেসে ফেলল, কেউ চিমটি কটল, কেউ হাই তুলল, কেউ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকল যেন এমন আজব প্রাণী কখেনো দেখেনি। কেউ কেউ বাইরের দিকে তাকিয়ে রাস্তার ওপারের কান্ডকারখানা দেখতে থাকল। এর কারণ অবশ্য পরে বুঝতে পারা গেল তিনিই একমাত্র শিক্ষক যিনি খাতা বইপত্র এনেছেন ঠিকই, কিন্তু বেত আনতে হবে একথা ভাবতে পারেন নি।

নবীন শিক্ষক ছাত্রদের নাম ডাকলেন। কেউ কেউ এমন ভাবে জবাব দিল যেটাকে বেয়াদবী বলা যায়। তিনি শুধু সহাস্যে শুধরে দিলেন। তিনি বললেন, আমাদের প্রথম কাজ হবে নিঃশব্দে সৃষ্টি কর্তার কাছে শিক্ষার সুযোগ দানের জন্য কায়মন প্রাণে আত্মসমর্পিত হওয়া। এক মিনিট নিস্তব্ধ প্রার্থনা। ছাত্ররা নিঃশব্দ না থেকে বরং নিজেদের মধ্যে সশব্দ কলকাকলিতে নিযুক্ত থাকল। কেউ কুকুরের ডাক, কেউ শেয়ালের ডাক অনুকরণ করল। নবীন শিক্ষক দরজা জানালা বন্ধ করেও শব্দের মাত্রা কমাতে পারলেন না। অন্য ক্লাশের শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকের কাছে নালিশ জানালেন। নবীন শিক্ষক কিছু একটা ভেবেই ছাত্রদের ছুটি দিয়ে দিলেন। ছাত্ররা দৌড় ঝাপিয়ে হৈ চৈ করে চলে গেল। প্রধান শিক্ষক কৈফিয়ত চাইলেন তৎক্ষণাৎ। নবীন শিক্ষক বললেন ছাত্রদের মন তো পড়ায় ছিল না। স্কুলকে ওরা ভালোবসে না, ওরা স্কুলের পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করে অবাধ্য হয়। আমাকে ওদের বুঝতে হবে, ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, তবেই না ওদের পাঠ শুরু হতে পারে। জোর করে ক্লাসে ধরে রেখে পড়া পড়া খেলা হয়, পড়াশোনা হয় না। নবীন শিক্ষকের নামে নালিশ গেল উপর মহলে। অসময়ে ক্লাস ছেড়ে দেয়ায় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং এ কারণে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব নিতে হবে এমন কড়া চিঠি পেলেন তিনি।

পরের দিন। কাস শুরু হলো। ছাত্ররা আবার হৈ চৈ করে ছুটির প্রত্যাশা করতে লাগল। নবীন শিক্ষক বললেন গল্প শুনবে? এবার সাড়া পাওয়া গেল। গল্প শুরু হলো। একটু বলেন তার পর থামলেন। ছাত্ররা বলে এর পরে কি? এভাবে বলতে বলতে স্কুলের সময় পার, গল্প কিন্তু শেষ হলো না। মহাভারতের গল্প রসিয়ে রসিয়ে শব্দের অর্থ অনুষঙ্গ বলে এর ভেতরে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুণাবলী ও আদর্শ আছে তা বলতে সময়ের দরকার। ছাত্ররা স্কুলের পরেও থাকতে চাইল। কিন্তু সেদিনের মত শেষ করে নবীন শিক্ষক বললেন কাল আবার হবে, কিন্তু তার আগে কিছু পড়তে হবে। প্রধান শিক্ষক এসে দেখে গিয়েছেন যে গোলমাল নেই কিন্তু পড়াশুনাও নেই। ছাত্ররা পরীক্ষায় ভাল করবেনা। তিনি এমনটি চান না। নবীন শিক্ষক বললেন শৃঙ্খলা চাই কিন্তু নিরানন্দ শৃঙ্খলা তো শিক্ষার আসঙ্গ সৃষ্টি করে না।

পর দিন স্কুলের দরজা খোলার আগেই ছাত্র হাজির। শিক্ষকও হাজির। গল্প চাই, সবুর সয়না। নবীন শিক্ষক জানতে চান কার কতটুকু মনে আছে। কি ভালো লেগেছে। কোন শব্দ নতুন শিখেছে। নতুন শব্দের বানান কে জানে। শব্দের প্রতিশব্দ কি হবে। শুরু হয়ে যায় শব্দ নিয়ে খেলা । অন্য ক্লাসের ছাত্ররাও ভীড় করে। শব্দ বলে, শব্দের অনুষঙ্গ বলে, শব্দ গল্পের কোথায় কেন এসেছিল তাও বলে। শব্দে শব্দে কথায় কথায় গল্পের আসঙ্গে ভাষার চর্চা হয়ে যায়। ক্লাস শুরু হয়। অন্য কাসে হৈ চৈ, এ ক্লাসে পড়া। অন্য ক্লাসও গল্প চায়। প্রধান শিক্ষক আবার আসেন। নবীন শিক্ষকের মত সব শিক্ষককে গল্প জানতে হবে? কেবল সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সব শিক্ষক মিলে উপরে নালিশ পাঠান। নবীন শিক্ষক বলেন, ঠিক আছে গল্প বলার ক্লাস হবে ক্লাসের শেষে। সন্ধ্যা হয় ছেলেরা বাড়ি ফেরে না। অভিভাবকেরা আসেন, আবার নালিস। স্কুলে তো পড়তে পাঠাই, গল্প শুনতে বা বলতে নয়। তখন ঠিক হলো গল্পের ক্লাস হবে সে সাথে খেলাও হবে, কিন্তু ছেলেদের সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেদের মুখ কালো। বেশি করে গল্প হবে না। আবার আলোচনা। গল্পের বই কেনা হবে। সবাই একটা করে বই কিনতে পয়সা দেবে। নবীন শিক্ষক টাকা জমা করে বই কিনে আনবেন।

কিছু ছেলে পরদিনই দশ পয়সা জমা দিয়ে দিল। অন্য ছেলেরা বলল তাদের বাবা মার মত নেই। কিছু ছেলে টিফিনের টাকা জামা দিল। আবার নালিস, নতুন মাস্টার কেবল ছেলেদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেন। ঠিক হলো পড়ার বই- এর পয়সা জমা দিয়ে থাকলে ফেরত দেয়া হবে। যারা পয়সা দিয়েছে তারাই প্রথমে বই পাবে, তবে অন্যরাও বই পড়বার সুয়োগ পাবে লটারী করে। বই পড়বার শর্ত হলো দুটো, বই- এ কি গল্প সেটা বলতে হবে সবাইকে আর ছোট্ট করে সেটা লিখে দেয়ালের বের্ডে টাঙ্গিয়ে দেয়া হবে। কার লেখা ভালো সেটা ঠিক করবে সবাই মিলে আর তাকে লেখার পেন্সিল কিনে পুরস্কার দেবেন নতুন মাস্টার। হাতের লেখা হলো, শব্দ লেখা হলো, নিজের মত করে লেখা হলো। ভালো-মন্দ বিচার হতে লাগল প্রায়শই, কটা বই এলো, কটা বই পড়া হলো, কত পয়সায় কেনা হলো, এসব করতে করতে অঙ্কের নেশা জমে গেল। কে নবীন শিক্ষকের সাথে এ কাজ গুলো করবে তার প্রতিযোগীতা চললো। এ সুযোগে যোগের নিয়ম, বিয়োগের নিয়ম, গুনের নামতা, ভাগের প্রক্রিয়া শেখাতে লাগলেন নবীন শিক্ষক।

প্রধান শিক্ষক বললেন এমন করে বই পড়ে পাগল হতে তো কখনই দেখিনি ছেলেদের। বই পড়ার নেশায় ক্লাসের পড়ায় ও মন এসছে কিন্তু সামনে যে স্কুলগুলোর শারিরীক প্রতিযোগিতা। কে নেবে ভার, আগে যিনি নিতেন তিনি তো বই-এর কাছ থেকে এদের সরাতে পারেন না। ভার পড়ল নবীন শিক্ষকের উপর। বই এর ক্লাস ছাটাই হবে না, কিন্তু ক্লাস শুরুর আগে খেলা হবে। নবীন শিক্ষক তাদের লাইন করে দাঁড় করালেন। কাউকে বললেন কাপড় ধুতে হবে। কাউকে বললেন দাঁত পরিস্কার হতে হবে। কাউকে বললেন বোতাম লাগাতে হবে জামায়। কাউকে বললেন নখ কাটতে হবে। বাড়ি থেকে নালিশ, এ কেমন তরো ব্যবহার। নবীন মাস্টার ছুটির দিনে সবাইকে নিয়ে ঘাটে বসবেন যার যার কাপড় কি ভাবে পরিস্কার করতে হবে ধুয়ে তারই তদারকীতে। এত কাপড় কোথায় শুকাবে। স্কুলের বারান্দায় দড়ি বাঁধা হলো। দুপুরের মাঝে সব শুকিয়ে সাফ। এর মাঝে দাঁতন করা হলো। নখ কাটা হলো, একনকি চুল ছাটানোও হলো। এবার খেলা, সুইয়ে সুতো ভরা আর জামা বা প্যান্টের বোতাম মেলানো বোতাম খুজে পাওয়া। দেখতে দেখতে হৈ হুল্লোড়ে সবার জামা কাপড়ে বোতাম লাগানো হলো। যারা পারেনা তাদের হাবা বলে অন্যরাই লাগিয়ে দিল মজা করে। এরপর হল কিভাবে ভাজ করে বালিশের নীচে রেখে দিলে এগুলো ভালো দেখাবে সেটা শেখানোর পালা। পরদিন সকালে প্রবীণ মাস্টার বিমোহিত, এত ভালো তো কখনই দেখায়নি এদের।

নবীন মাস্টার কিন্তু এত তুষ্ট হলেন না। বললেন সামনের রোববার স্কুল পরিস্কার হবে আর ক্লাস সাজানো হবে। ঝাড়– লাগবে, সোডা লাগবে, বালতি লাগবে। কে দেবে খরচ? মাস্টারের বাড়ি থেকে ঝাড়– আর বালতি এল আর সোডা এল এক অভিভাবকের দোকান থেকে। মেঝে সাফ হলো। চেয়ার বেঞ্চ ধোয়া হলো, জানালা দরজা মোছা হলো। এর মধ্যে থেকে তৈরি হলো কাজের ব্রিগেড। সহকর্মের মাঝে তৈরি হলো সহমর্মীতা। প্রবীন মাস্টার তবুও বলেন শরীরচর্চার কী হলো। তিনিই তাদের নিয়ে গেলেন মাঠে, দলে দলে ভাগ করালেন, কোন দল কাবাটি খেলল, কেউ দাড়িয়াবাঁধা, কেউ গোল্লাছুট। কিন্তু গোল বাধল খেলা শেষে যখন জিতিয়ে দল হারিয়ে দলকে ঠাট্টা করছিল তখন কেউ একজন মারল ঢিল আর তা যেয়ে লাগল কাজনার কপালে, রক্ত বেরুল। কান্নাকাটি মারামারি ঠেকায় কে? ডাক পড়ল নবীন মাষ্টারের তিনি তাড়াতাড়ি নিজের জামা ছিড়ে রক্ত মুছিয়ে ব্যান্ডেজ করে সবাইকে লাইন বেঁধে দাঁড় করালেন। তিনি গান বাঁধলেন খেলা হলো সবার মিলন মেলা, কেউ হারে খেলাতে কারো হয় জিতে ফেলা কিন্তু খেলা শুধুই খেলা, হারজিত আছে এতে ভেদাভেদ নেই তাতে একসাথে মিলে থাকা সেই হলো সার। 

প্রথমে আস্তে আস্তে কেউ কেউ গলা মেলাল তারপর তালি দিয়ে দিয়ে সবাই জোর গলাতে গান বাধল। নবীন মাস্টার শুধু বললেন, মনে থাকবে তো তাহলেই রোজ খেলা হবে, না হলে সব বন্ধ। সবাই দৌড়ে এসে নবীন মাস্টারকে হাতে ধরে বলল, স্যার ভুল হয়ে গেছে আর হবে না। প্রবীণ মাস্টার গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কিন্তু নবীন মাস্টারের চোখ তখন সিক্ত। প্রবীণ মাস্টারকে বললেন ওদের ভালবাসা পেয়েছি দেখবেন ওরা পড়াশুনায়ও ভালো করবে। কেবল ক্লাসের বই নয়, ওরা এখন নানা ধরনের বই পড়াবার স্বাদ পেয়েছে, দেখবেন ওদের পড়া আর লেখা দুটোতেই ভালো হবে। আর হিসাব শিখেছে, শুধু অঙ্কের সূত্র ধরিয়ে দেয়া, তাহলেই বাকিটা হবে। কিন্তু শিক্ষ কি কেবল কপাতা পড়া, কটা আঁক কষা? ওদেরকে ভালো জীবনের জন্য তৈরি হতে হবে। সবাই ভালো ছাত্র হয় না, কিন্তু সবাই ভালো মানুষ হতে পারে, আমরা যদি ওদেরকে যান্ত্রিকতায় বেপথু না করি। প্রবীণ মাস্টার শুধু বললেন, উকিল ছিলেন শিক্ষার এ ভাবনা কোথায় পেলেন। নবীন শিক্ষক হেসে বললেন, নিজের ছেলেকে ভালোবেসে সব ছেলে মেয়েকেই ভালো বেসে ফেলেছি, ওখান থেকেই আমার শিক্ষা ভাবনার শুরু। আমরা শিক্ষকেরা কি এমনভাবে ভাবি, ভেবেছি বা ভাবতে পারি?

পরদিন অভিভাবকের একদল এসে প্রবীণ মাস্টারের কাছে হাজির। তাদের অভিযোগ ছাত্ররা বাড়ির ময়লা কাপড়, চাঁদর, পর্দা, বালিশ, বাসন, দুয়ার এসব নিয়ে মায়ের সাথে বোনের সাথে তর্ক করছে আর সব সাফ না হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এমন ভয়ও দেখাচ্ছে। অভিভবকদের সাথে এসেছেন পৌর কমিশনার যিনি বিদ্যালয় পরিদর্শকও বটে। প্রবীণ শিক্ষক মাথা চুলকালেন কিন্তু বললেন, ওরা কি অন্যায় কিছু করেছে? 

বাড়িতে জ্বালাতন করছে এর চাইতে অশিক্ষা কি হতে পারে?

এদের বিদায় করে ডাকলেন নবীন শিক্ষককে, বললেন এমন হলে তো ছাত্র চলে যাবে, সাহায্য বন্ধ হবে, স্কুল উঠে যাবে। নবীন শিক্ষক বললেন, শিক্ষার তাৎক্ষণিকতা উৎরে ওরা জীবনময়তা বুঝতে পেরেছে, এতে আমার আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু ওদের আমি বোঝাবো, ওদের সাথে প্রয়োজনে ওদের বাড়িতে যাব, ওদের বাবা মার সাথে কথা বলব। স্কুলের চার দেয়ালে শিক্ষা আবদ্ধ থাকলে সে শিক্ষা অনর্থক, শিক্ষা তো জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি, সহজ সরল কিন্তু অর্থবহ জীবন, পরিচ্ছন্ন সুন্দর জীবন; চাকুরী হলো জীবিকা, শিক্ষা তো জীবিকার জন্য নয়, শিক্ষা হলো সমাজবদ্ধ মানবতার বীজ বপনের বুদ্ধিদীপ্ত হাতিয়ার। 

নবীন শিক্ষক যান ছাত্রদের বাড়ি, অভিভাবকেরা তটস্থ হন। আলাপচারিতা হয়। সবশেষে হলো ছেলের বর্তমান পরিবর্তিত মানসিকতা নিয়ে উদ্বেগ। নবীন শিক্ষক বলেন, ছেলে নয় দোষ তারই। তিনি ক্ষমাপ্রার্থী, কারণ ওদের সাথে নিয়েই শিক্ষার নির্যাস স্কুল থেকে গৃহে প্রসারণ তার করা উচিত ছিল। তারপর ছাত্রকে নিয়ে কুয়ার ধার সাফ করলেন। গাছ তলার পাতায় আগুন লাগালেন, পয়ঃব্যবস্থা ধুয়ে দিলেন, ঘরে আলো বাতাস আসতে পারে সে জন্য আসবাব বদল করে ছেলে যেখানে মাদুর পেতে পড়ে সে জায়গাটা গুছিয়ে দিলেন। অবশ্য কিছু সময় যেতেই বাড়ির সবাই তার সাথে হাত লাগালেন। কাজ শেষ হবার আগে ময়লা কাপড়গুলো কুয়ার পাড়ে জমা করে গরম পানিতে সাবান লাগিয়ে রেখে আসলেন। বললেন, ধুয়ে নেড়ে দেবেন, শুকিয়ে যাবে। বাড়িতে সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবন স্কুলের জীবনকেও সুন্দর করে দেয়। 

নবীন মাস্টারের গৃহ নবায়নের আনন্দময় কাজ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায় পাড়ায়। স্কুলে এসে তার খবর দিয়ে যেতে লাগলেন অভিভাবকেরা স্বয়ং। ক্ষুব্ধ হলেন স্কুলের শিক্ষরা, স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যরা, পড়াতে এসে সমাজ সংস্কার তো তাদের কর্ম নয়। অবৈতনিক উদ্ভট চিন্তার মানুষ সম্পর্কে উপরের মহলে নালিশ যেতেই লাগল। শিক্ষা পরিচালক তাই নিজে না জানিয়ে উপস্থিত স্কুল শুরু হবার আগেই। দূর থেকে দেখলেন সব ছাত্র এসে নবীন শিক্ষককে প্রণাম জানিয়ে যায়, তার সাথে কথা বলে, কিন্তু অন্য কোন শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের এমন সম্পর্কেই নেই বরং ছাত্ররা তাদের দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় যাতে নমষ্কার না জানাতে হয়। স্কুল বসলে শিক্ষা পরিচালক এলেন স্কুলে। সব শিক্ষকই স্বদেশী নবীন শিক্ষকের শিক্ষাদান সম্পর্কে জ্ঞানহীনতাকেই নিন্দাবাদ জানালেন। শিক্ষা পরিচারক বললেন, তাহলে পরীক্ষা হোক আজই। শিক্ষকেরা তটস্থ, ছাত্ররা বিব্রত।

প্রথমে গেলেন নবীন মাস্টারের ক্লাসে। বললেন প্রশ্ন কর, লিখতে দাও কেমন শিখিয়েছ দেখি। নবীন শিক্ষক তাদেরকে লটারী করে একটি বইয়ের যে কোন গল্প বেছে নিতে বললেন। প্রশ্ন হলো সার সংক্ষেপ লিখতে হবে, কিন্তু বইয়ের শব্দের কোনটিই ব্যবহার না করে বিকল্প শব্দ ব্যবহার করে এটি করতে হবে। পড়তে সময় দশ মিনিট, লিখতে সময় দশ মিনিট। তার পর একে অন্যের খাতা দেখবে দশ মিনিট। শিক্ষা পরিচালক তো হতবাক। পরীক্ষার শেষে ছেলেদের খাতা দেখা শেষ হলো, তারপর নবীন শিক্ষক প্রতিটি খাতায় আরও কি শব্দ ব্যবহার হলে ভাষার ব্যঞ্জনা ভালো হত, কোথায় কোন ভুল বানান হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে পনের জনের জন্য তিরিশ মিনিট ব্যয় করলেন। তারপর শিক্ষা পরিচালককে বললেন, এবার ওদের মূল্যায়ন আপনি করুন, নম্বর দিয়ে ভালো মন্দ নির্দেশ করবেন না। ওদের বলুন কতটুকু শিখেছে, আর কি শিখতে হবে কতদিনে সে শেখা আপনি দেখতে চান। আবার অবাক হলেন শিক্ষা পরিচালক, নবীন শিক্ষক বললেন, এক পরীক্ষার নম্বর ওদের শিখনের মানকে নির্দেশ করে না, পরীক্ষা হলো ওদের যাত্রাপথের মাইল ফলক, কে কতটুকু পিছিয়ে আছে, কাকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তারই একটি প্রক্রিয়া । ভুল বানান, ভুল শব্দ ব্যবহার, সবই আছে। কাল আবার ওরা লিখবে, আমি কাউকে শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট বলি না। ওতে ওদের মধ্যে বিভাজন আসে। সবে মিলে শেখার আনন্দ চালে যায়। ওদের নতুন নতুন পড়া থাকে, বাড়ির কাজ থাকে, ক্লাসে পাঠ হয়। সবই আছে এ পদ্ধতিতে। 

শিক্ষা পরিচালক চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন পরীক্ষা পদ্ধতির নব ব্যবহার বিমোহিত হয়ে। নবীন মাস্টার বলছে, শিক্ষার কেন্দ্রে তো ছাত্র, শিক্ষক কেবল উজ্জীবক, তার শাসনের প্রয়োজন নেই, আছে বন্ধনের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে সাথীর ভুমিকা। সাথী হিসাবে তাকে সুপথ চেনাবার কাজ না করতে পারলে বিফলতা শিক্ষকেরও, ছাত্রের শুধু নয়। পথ চলার আনন্দেই ওরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়, ওরা একত্রে কাজ করতে শেখে, ওরা বইয়ের বাইরে পৃথিবীকে জানতে চিনতে শেখে। ভূগোল পড়তে ওরা তথ্য মুখস্থ করে না, দেশ সম্পর্কে জানে আর দেশ থেকে দেশের পার্থক্যটা বুঝে নেয়, বুঝে নেয় তার কারণ, ভুগোল বই যেভাবে তথ্যাকীর্ণ তাতে তো ওদের আনন্দ হয় না, ইতিহাসে রাজা-রাজরার কাহিনী পড়ে ওদের আনন্দ হয় না, কিন্তু মানুষ সে সময়ে কিভাবে বসবাস করত, কিভাবে জীবনকে সমৃদ্ধ করত, কি কারণে তারা অধঃপাতে যেত এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজে। ইতিহাসকে দেখে তারা অতীতের আলোকে নয়, বর্তমানের বাস্তবতায়। তারা এনিয়ে গল্প লেখে, নাটক লেখে, পদ্য লেখে, গান লেখে, শিক্ষা পরিচালক সব শুনলেন দেখলেন। প্রশ্ন করলেন, বৃত্তি পরীক্ষায় কী হবে? নবীন শিক্ষক শুধু হাসলেন। সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, বিজ্ঞান, অংক, ধর্ম, সংস্কৃতি, গান, ছবি আঁকা সব একাকার হয়ে যেতে থাকে, অন্বিত হয়ে যায়, এদের ভেতরে পারস্পরিক সম্পর্কও স্পস্ট হয়ে দেখা দেয়। ছাত্রদের নতুন নতুন প্রশ্ন মনে জাগে। ক্লাসে সেসব আলোচিতও হয়। 

নবীন শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন শিক্ষা পরিচালক। তার অভিযোগ কি করে এমনভাবে পড়ানো হলে এতদিনের পদ্ধতিকে রক্ষা করা যাবে। নবীন শিক্ষক তো সব লন্ড ভন্ড করে ফেলছেন। শিক্ষকতা তো একটি নির্দিষ্ট কাজ, একে তা গন্ডীবদ্ধ না করলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হবে। নবীন শিক্ষক বিনয়ের সাথে বললেন, যাঁরা বই লেখেন তাঁরা পন্ডিত, তার পন্ডিত্য অনেক কম, কিন্তু পন্ডিতেরা শিশুর মনকে কি করে ছুঁতে হয় তা জানেন না বলে বিধিবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট ছকে জ্ঞানসমৃদ্ধ যে বই লেখেন তার সাথে ছাত্র তো নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। কিন্তু ঐ জ্ঞানই তাকে দেয়া যায় তার গৃহ, পরিবেশ, স্কুল, লোকালয়, পুরান বর্তমানের সত্যকাহিনীর বাস্তবতায় যা সে বোঝে। শিক্ষকতা একটা ধর্ম, একে জীবনে ধারণ করতে হয়, জ্ঞানী মাত্রেই শিক্ষক নন। নবীন শিক্ষক বিদায় নিলেন, শিক্ষা পরিচালককে নানাবিধ প্রশ্নের সামনে ফেলে দিয়ে। পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যাভ্যাস, পাঠদান সবই তো নতুন করে ভাবতে হবে। জ্ঞানের অন্বেষায় জীবন, না জীবনের অন্বেষায় জ্ঞান তারও তো মীমাংসা হলো না। তবে এটা ঠিক জীবনকে ঘিরেই শিক্ষা, জীবনকে নিয়েই শিক্ষা, জীবনের প্রয়োজনে প্রয়োজনকে আত্মস্থ ও সম্পৃক্ত করেই শিক্ষা। আর শিক্ষায় ছাত্রের মনোসংযোগ ঘটে যখন তার মনকে মানসকে মননে আপ্লুত করে দেওয়া যায় কৌতুহলের কোলাহলে। কেউ ওদের শেখাতে পারে না, শিখবে ওরাই কিন্তু শিক্ষার সাথীই হলো শিক্ষক। 

নবীন শিক্ষক ঠিক করলেন তিনি কতটুকু করতে পেরেছেন তার পরীক্ষা হওয়া উচিৎ। কে নেবে সে পরীক্ষা। তার মন তাকে বলে দিল পরীক্ষক তো ছাত্ররা, কারণ ওরা কতটুকু প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছে তা থেকেই তো আমার সার্থকতা যাচাই হবে। ছাত্রদের বললেন তার পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন আর পরীক্ষা হবে ছাত্ররা শিখেছে সেটাকে সংবদ্ধভাবে অভিভাবকদের কাছে উপস্থাপন করে। ছাত্ররা বিচলিত, শিক্ষকদের পাগল হবার পালা। প্রবীণ শিক্ষক তাকে নিবৃত করতে চাইলেন, কিন্তু নবীন শিক্ষক বললেন আমার তো পূর্ণ দায়বদ্ধতা আছে এই ছাত্রদের কাছে, এদের অভিভাবকদের কাছে কিন্তু আপনাদের কাছে সামান্যই। প্রবীণ শিক্ষক তার নীতিবোধে প্রশংসা করলেন, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটি আবার ভেবে দেখার জন্য নির্দেশ দিলেন। 

নবীন শিক্ষকের পরীক্ষার দিন এল স্কুলের প্রাঙ্গণে ছুটির পরে প্রায় সকল ছাত্র, অভিভাবক ও উৎসাহিত পথিক উপস্থিত। খবর পেয়ে শিক্ষা পরিচালকও এসেছেন। ছাত্ররা বেঞ্চ জোড়া দিয়ে মঞ্চ বানিয়েছে। সামনে দাসা লংক্লথের পর্দা ঝুলছে। পিছনে কালো পর্দা। ঘন্টা পড়ল। পর্দা সরে গেল। সব ছাত্র সারিবদ্ধ হয়ে প্রনায়ম করে বসে, তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালো। নিরব এক মিনিট। তারপর সমস্বরে উচ্চারণ করল- ওঁ শান্তি। এরপর হল গান যেটি জ্ঞানের জন্য প্রার্থণা মঙ্গলময়ের কাছে। ছাত্ররাই খুঁজে বের করেছে তাদের লাইব্রেরী থেকে। তারপর নেচে নেচে নিজেদের এমনভাবে সাজালো যে সেটা দেশের মানচিত্রের মত দেখাল। শহরগুলোর স্থানে যারা ছিল তারা প্লাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে পড়ল। হাতে হাত ধরে কখনো রেল পথ, কখনো জল পথ, কখনো স্থল পথ নির্দেশ করল। ছাত্ররা সরে দাড়াল। তারপর তাদের শোনা এ দেশের অতীতের রাজা প্রজা সম্পর্ক নিয়ে মনুষ্যত্ব ও মানবতার একটি নাটিকা অবতারনা করল। সেখানে তাঁতী এলো, কুমার এলো, কামার এলো, কৃষক এলো, দর্জি এলো এমনভাবে জীবনের সব ছবি হল নাটকের আসঙ্গ। একজন করে মাঝে মাঝে গল্প বলল মহা মানবের জীবন থেকে নিয়ে শিক্ষা পাওয়া যায় এমন সব ঘটনা। কখনো মাতৃভাষায়, কখনো ইংরেজীতে চলল উপস্থাপনা। সব ছেলেরাই পরিচ্ছন্ন ও পরিস্কার পরিপাটি। সব উপস্থাপনার সাথেই ছিল পাঠ্যক্রমের যোগাযোগ। এসবই শেষ হল। নবীন শিক্ষক উঠে এসে হাত জোড় করে বললেন, বছর শেষ হয়ে এসেছে, সামনে বৃত্তি পরীক্ষা। ওদের পাঠ্যক্রম আমি আমার মত করে ওদের কে সাথে নিয়ে আত্মস্থ করেছি। সব স্বার্থকতা ওদের আর আপনারা যদি কোন ত্রুটি দেখে থাকেন, সে ত্রুটিটুকু আমার। আমার অবৈতনিক কর্মের আজ শেষ দিন। আপনাদেরকে নানা যাতনার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু প্রার্থনা করি নিয়মতান্ত্রিকতার যাতাকলে শিশুর শিক্ষাব্রতী মনকে শুকিয়ে মারবেন না। 

কথা শেষ হল, কিছু হাততালি পড়ল। কিছু দীর্ঘশ্বাস, কিছু উচ্ছ্বসিত অশ্রুকণা। তারপর স্কুলের সব ছাত্র এসে নবীন শিক্ষককে ঘিরে নাচতে লেগে গেল আর গাইতে লাগল যেতে নাহি দিব। বিমুগ্ধ অভিভাবক আর শিক্ষকরা কি তখন দর্শক হয়ে থাকতে পারেন? শিক্ষা পরিচালক শুধু বললেন, আমার ত্রিশ বছরের শিক্ষা পরিচালনায় আজ নতুন নির্দেশনা পেলাম। শিক্ষার সবকিছুই নিত্যনতুন করে ভাবতে হবে, গিজুভাই ভাদেকার এক বছরের শিক্ষা অনুসঙ্গের সাথে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার যে বিস্তর ফারাক, সেটা কি করে দূর করা যায়, সেটা হোক আমাদের সবার সাধনা, বিশেষ করে যারা শিক্ষা নিয়ে ভাবছেন, কাজ করছেন, সাফল্যের কীর্তিগাথা প্রচারে এমন উচ্চকিত যে, বিনয় তিরোহিত হয়ে থাকছে।