সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

শিক্ষক, শিক্ষার কৌশল ও স্টুডেন্ট সাইকোলজিো( ১ম অংশ)

শিক্ষা :
আভিধানিক অর্থে- শিক্ষা হচ্ছে, শেখা, অভ্যাস, অধ্যয়ন, জ্ঞানার্জন, চারিত্রোন্নতি। সু-অভ্যাস বা ক্রমাগত অনুশীলন শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। ল্যাটিন শব্দ Educo থেকে ইংরেজী Education  শব্দের উৎপত্তি।  Educo শব্দের মূলগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- E = Out; duco = to lead, to draw out বা পরিচালিত করা, বের করা, প্রতিভাত করা। Education এর তাৎপর্য হচ্ছে, মানব মনের সহজাত  বৃত্তি বা সম্ভাবনাকে বিকশিত ও পরিচালিত করাই শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ইউরোপীয় E (ই) উপসর্গের একটা অর্থ অভাব আর এক অর্থ বর্হিগমতা; Educate শব্দের উৎপত্তিমূলক অর্থ বহির্ণয়ন। এই অর্থ-সূত্রেই তিনি বলেছেন, “আমাদের যে শক্তি আছে তাহারই চরম বিকাশ হইবে, আমরা যা যাহা হইতে পারি, তাহা সম্পূর্ণভাবে হইব- ইহাই শিক্ষার ফল।” মোটকথা, মানুষের অন্তর্নহিত গুণাবলীকে স্ফুরিত, নিগরিত ও নিয়ন্ত্রিত করে জীবনের নানা প্রয়োজেনে তাকে উক্ত গুণগুলো প্রয়োগ করার শক্তি ও নৈপুণ্য দান করাই শিক্ষা। 

শিখন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্র:

বিখ্যাত শিক্ষা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম (Benjamin Samuel Bloom) দীর্ঘ গবেষণা করে ১৯৫৬ সালে শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়াকে তিনটি ক্ষেত্রে (Domain) ভাগ করেছেন :
১.    বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র  (Cognitive Domain)
২.    আবেগীয় ক্ষেত্র   (Affective Domain)
৩.    মনোপেশিজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain)
৪.    বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র  (Cognitive Domain): মস্তিস্কই আমাদের বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষেত্র। মানুষ কোন বই পুস্তক, পত্র-পত্রিকা পড়ে সিনেমা নাটক দেখে কোন অনুষ্ঠান বা আলোচনা শুনে নিজের মধ্যে যে জ্ঞানমূলক দক্ষতা তৈরি করে তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র বা চিন্তন দক্ষতার ক্ষেত্র বলে। এ ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তর রয়েছে -
                                                            মূল্যায়ন 
                                                  সংশ্লেষণ  
                                         বিশ্লেষণ  
                               প্রয়োগ
                   অনুবাধন
            জ্ঞান 
৫. আবেগীয় ক্ষেত্র   (Affective Domain): শিক্ষার্থীর আবেগেরে বিভিন্ন দিক ধীরে ধীরে গড়ে উঠে।
     যেমন-         
                                                                                  আত্মস্থকরণ (Internalizing)
                                                                মূল্যবোধ সংগঠন (Organizing)
                                              মূল্যবোধ  বিচারকরণ (Valuing)
                            সাড়া প্রদান (Respond)
                  গ্রহণ (Receiving) 
                                            
৬. মনোপেশিজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain) : এ ক্ষেত্রে মন এবং পেশির সমন্বয় করে শিক্ষার্থী কোন বিষয় হাতে কলমে শিখে। সকল ব্যবহারিক এবং ট্রেড জাতীয় বিষয এ শিখন ক্ষেত্রের আওতাভুক্ত। এ শিখন প্রক্রিয়াটি শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে শিখে। নিম্নের চিত্রটি লক্ষ্য করি- 
                                                          স্বাভাবিকীকরণ (Naturalization)
                                             শিল্পিতকরণ (Articulation) 
                                   যথার্থকরণ (Precision)  
                 নিপুণতার সাথে কার্যসাধন  (Manipulation)
অনুকরণ (Imitation)   

শিক্ষা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম দেখিয়েছেন, শিখন প্রক্রিয়াটি যে ক্ষেত্রেই ঘটুক না কেন, তা ধাপে ধাপে বা  স্তরে স্তরে সম্পাদিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিক্ষাবিজ্ঞানী এ বিষয় আরও গবেষণা করে নতুন ধারনা প্রদান করেন। 
নিম্নের চিত্রটি লক্ষ্য করি -

শিক্ষক ও নেতৃত্ব:

The fifth discipline’ বইয়ে একটা উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, “Leader as teacher’ is not about ‘teaching’ people how to achieve their vision. It is about fostering learning, for everyone. Such leaders help people throughout the organization develop systematic understanding.” একজন শিক্ষক যখন কেবল মাত্র শিক্ষক তখন কেবলমাত্র পঠন-পাঠন কার্যক্রম পরিচালনা, মূল্যায়ন ও প্রশাসনিক নিয়মিত দায়িত্ব পালনই এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন নেতা, অর্থাৎ নেতৃত্বের গুণাবলির ছোঁয়া তার ভেতর থাকে তখন শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজেকে দাঁড় করাতে পারেন একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে।কাজেই শিক্ষককে তার শিক্ষণ-শিখন দক্ষতার সাথে নেতৃত্বের গুণাবলীও রপ্ত করা চাই।প্রথমত, একজন শিক্ষককে বর্তমানের প্রচলিত জ্ঞান সম্পর্কে নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে। একজন শিক্ষক তখনই একজন স্বার্থক শিক্ষক যখন তিনি একজন ““life-long learner’. শিক্ষকের জ্ঞান সম্পর্কে পিপাসা, সৃজনশীল মনোভাব এবং সময়ের সাথে শিক্ষকতার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজেকে পরিবর্তন করে চলা শিক্ষককে এগিয়ে নিয়ে যায় আরও অনেকখানি ধাপ উপরে। আর সেখানেই একজন শিক্ষক প্রকৃত অর্থে নেতা হয়ে উঠতে পারেন।দ্বিতীয়ত হল, যোগাযোগের দক্ষতা। একটা স্বার্থক শিক্ষণ-শিখন পরিবেশ গঠনের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক সঠিক তথ্যটি নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তা শিক্ষার্থীদের সাথে আদান-প্রদান করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সময়োপযোগী জ্ঞান থাকতে হয়।You cannot learn unless you listen”.
কাজেই শুনতে হবে সহকর্মী থেকে শিক্ষার্থী সকলের কথা।
একজন ভালো শ্রোতা নতুন ধারণা, পদ্ধতি, নীতিমালা গ্রহণে সদা প্রস্তুত থাকেন। একই সাথে নতুন জ্ঞানকে গ্রহণ ও আদান-প্রদান করা, সহকর্মীদের সাথে একটা বিশ্বস্ত সম্পর্ক স্থাপন, রিসোর্স প্রভাইড করা, শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা, উপস্থাপনের দক্ষতা, শ্রেণীকক্ষে সহযোগী মনোভাব, বিদ্যালয়ে লিডারশিপ ধারণা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্পষ্ট জ্ঞান, পরিবর্তনশীল মনোভাব, প্রেষণা প্রদান, পরিকল্পনা প্রণয়ন, সাংগঠনিক দক্ষতা, সমন্বয় সাধনের দক্ষতা ইত্যাদিকে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য বৃদ্ধিতে শিক্ষকের গুণাবলি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া :

শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ একটি দ্বিমুখী আনন্দময় স্বচ্ছন্দ প্রক্রিয়া। তাই শিখন শিখানো কথাটি দ্বিমুখী অর্থবহন করে। শ্রেণীতে পাঠদানের  দু’ রকম পদ্ধতি আছে-
১. শিক্ষক  কেন্দ্রিক    ২. শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক

শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষকের ভূমিকাই মূখ্য, এই পদ্ধতি গতানুগতিক ও বৈচিত্রহীন। এখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে না। আর শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর ভূমিকাই মূখ্য থাকে। শিক্ষকরা যদি উভয় পদ্ধতিতে পাঠদান করেন তবে যে সকল সুফল বয়ে আনবে তা হল -

    ক. শিক্ষার্থীকে বিষয়বস্তু অনুধাবনে সক্ষম করে তোলে। 
    খ. শিক্ষার্থীর মত প্রকাশের অনুভুতিতে নাড়া দেয়।
    গ. শিক্ষার্থীর আচরণের সাথে বিষয়বস্তুর একটা তুলনামূলক স্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। 
    ঘ. মুখস্থ করার প্রবনতা দূর হয় এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।

শিখন পদ্ধতি ও কৌশল :

আমাদের জীবনে অনেক শিক্ষকেরই প্রভাব রয়েছে। আমরা এখনও অনেক শিক্ষকের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ব্যক্তি মানুষটির জন্য নয়, পড়ানোর কৌশলের জন্য, যা আমাদের বিবেকবোধ, আবেগ অনূভূতিতে নাড়া দেয়। সুতরাং শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীর আচরণিক পরিবর্তনে শিক্ষক যে সকল শিখানো পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করতে পারেন, পরিবেশ ও শিক্ষার্থীর মান বুঝে তা অবলম্বন করা উচিত, যেমন-  
১. বক্তৃতা (Lecture)                   ২. বক্তৃতা  আলোচনা (Lecturette)   
৩. স্থান পরিদর্শন (Site Visit)        ৪.  প্রদর্শন (Demonstration)     
৫.  শিক্ষামূলক ভ্রমণ ও মাঠ পরিদর্শন (Study tour & Field work)
৬. দলীয় আলোচনা (Group Discussion)    
৭. প্যানেল ডিসকাশন (Panal Discussion)    
৮. ঘটনা বিশ্লেষণ (Case Study)    ৯. ব্রেইম স্টর্মিং (Brain storming)    
১০. ভূমিকানয়ন (Role Play)        ১১. পাঠ নির্দেশনা (Guided Study)
১২. সিমুলেশন খেলা (Simulation Play)        
১৩. প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি (Question-Answer Method)
১৪. সতীর্ত দলভিত্তিক শিখন (Peer Group Learning)
১৫. সমস্যা সমাধান (Problem Solving Learning)
১৬. পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষাদান (Interactive teaching).

অষ্ট্রেলিয়ার ৭০ বছর বয়স্ক একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, Learning just a fun অর্থ্যাৎ শিক্ষণ হচ্ছে একটা মজা। বস্তত: একজন শিক্ষক শিখন- শিখানো পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষাদান পরিবেশটাকে আকর্ষণীয়, আনন্দময় ও মজাদার করে তুলবেন। 
শিক্ষকের দায়িত্ব ফ্যাসিলেটেটর (Facilitator), স্যার জন এ্যাডমস শিক্ষককে “মানুষ গড়ার কারিগর” (A  Maker of Man)  বলেছেন, আবার  আধুনিক শিক্ষাবিদরা বলেন- শিক্ষক হচ্ছেন “ÒA Teacher is a Change Maker” অর্থাৎ পরিবর্তনকারী সমাজ ও শিক্ষার্থীর জীবন এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই ফলপ্রসু শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক ফ্যাসিলেটরের (Facilitator) অর্থাৎ সহায়তাকারীর ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে কিছু দায়িত্ব পালন করবেন।  
যেমন -       
১. সংগঠক   ২. উদ্ভাবক    ৩. শ্রেণী ব্যবস্থাপক  ৪. প্রদর্শক    ৫. পরিচালক        
৬.. ন্যায় বিচারক   ৭. উদ্ধুদ্ধকারী ৮. পরামর্শ দানকারী    ৯. অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ১০. পরিকল্পনাকারী    ১১. স্বপ্ন দ্রষ্টা।

একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দেবেন। জীবনের স্বপ্ন পূরণের কথা তিনি এ ভাবে বলবেন- “Dream is not what you see in sleep, is the think which does not let you sleep


মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস : মনে উঁকি দেয়া কিছু প্রশ্ন করা যাবে কী?

শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস( ১৪ ডিসেম্বর)
কিছু প্রশ্ন করা যাবে কি?
_____________________________________________
গতকাল ছিল১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় গতকালও হয়ত রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফুল দিয়ে গণহারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। রায়েরবাজারের গতকালের পরিবেশটা দেখলে মনে হবে, কতো না যত্ন করে এই জায়গাটাকে সুরক্ষিত এবং পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অবস্থা থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
সন্ধ্যা হলে কেন্দ্রীয় শহীদি মিনারে বসে গাজার আসর। এক দল বাউন্ডুলে গিটার গাধে নিয়ে গান ধরে, “গাজার নৌকা পাহাড় তলি যায়, ও মিরা ভাই! গাজার নৌকা পাহাড় তলি যায়! গাজা খাব আটি আটি, মদ খাব বাটি বাটি”। সেখানকার অবস্থাটা এমন যে, সম্ভব হলে শহীদ মিনারের বুকেই গাজার চাষ শুরু করে দিবে কিংবা মদের বার খুলে বসবে! গাজার চাষ সম্ভব না হলেও মধ্যরাতে শহীদ মিনার হয়ে ওঠে অস্থায়ী মদের বার। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মাস আসলেই এই স্থানগুলো হয়ে ওঠে দেশের সর্বোচ্চ তির্থস্থান। তেমনি রাত হলেই রায়েরবাজার বধ্যভূমি হয়ে ওঠে নেশাখোরদের আশ্রয়স্থল। লোক মুখে শোনা যায় সেটি নাকি হিরোইনচিদের অভয়্যারন্য । প্রতি বছর এই গর্বের এই মাসগুলো আসলে প্রশাসনের যেমন টনক নড়ে তেমনি আমাদের মত চুনেপুটি ব্লগাররাও এসব নিয়ে স্বরব হয়ে ওঠে। তাই এই সব স্থানের সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিসহ আমাদের সকলের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করবার উদ্বার্ত আহব্বান জানিয়ে আমি মূল বক্তব্যে চলে যাচ্ছি।
এ যাবত পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড কারা ঘটিয়েছে তার সঠিক উত্তর জানা না গেলেও তার বিপরীতে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে যাচ্ছি! যে প্রশ্ন ইতিহাসই বার বার সমানে টেনে নিয়ে আসে। আর প্রশ্ন না থাকলে উত্তরও আসবে না। তাই ইতিহাসের সেই প্রশ্নগুলো আবারো সামনে নিয়ে আসার চেষ্ঠা করছি। যদি সম্ভব হয়, তাহলে তথ্যসহ উত্তর দিয়ে আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করবার অনুরোধ রইল।
সেই দিন যেসব বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলিম চৌধুরী। সেই আলিম চৌধুরীর বিষয়ে ইতিহাস বলে, “১৯৭১ সালে ডাঃ ও মিসেস আলিম চৌধুরী ঢাকায় পুরানা পল্টনে একটি তিনতলা বাড়িতে বাস করতেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলিম চৌধুরীর তিনতলা বাসার নিচতলায় ছিল তার নিজের ক্লিনিক ও উপরের দু’টি তলায় তারা নিজেরা বসবাস করতেন। ডাঃ চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক। আশ্চার্যের বিষয় হলো এই ডাক্তার পরিবারটি কট্টর পাকিস্তানী সমর্থক একজন আল বদর সদস্যকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার নাম ছিল মাওঃ মান্নান।
পরবর্তি মাসগুলোর দৈনন্দিন জীবনের যে বর্ণনা মিসেস আলিম চৌধুরী দিয়েছেন তা ছিল যুক্তিতর্কের বাইরের এক পরিস্থিতির বিবরণ। নীচতলায় পাক সেনারা যাওয়া-আসা করত মাওঃ মান্নানের কাছে এবং প্রায়দিনই তারা সেখানে থাকতো অনেক রাত পর্যন্ত। আল বদর সদস্যরা মাওঃ মান্নান ও ডাঃ চৌধুরীর গেট পাহারা দিতো। অন্যদিকে উপর তলায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন ক্লিনিকে আসতো ওখানে তাদের ফ্রি চিকিৎসা দিতেন ও প্রয়োজনে তারা ডাঃ আলিমকে গাড়িতে করে নিয়ে যেতো নিরাপদ স্থানে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরী মিসেস চৌধুরীকে ডেকে পাঠান ও জিজ্ঞেস করেন নীচতলায় আল বদরের আসা যাওয়া আর উপর তলায় মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা নিয়ে আপনারা কি ভেবেছেন? মিসেস চৌধুরী এর কোন উত্তর দিতে পারেন নি। কেন মাওঃ মান্নান কে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেন নি,মিসেস চৌধুরী”। ( শর্মিলা বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৪৯-১৫০ দ্রঃ)
কিন্তু সেই আল বদর সদস্য মাওঃ মান্নান পরবর্তিতে ডাঃ আলিম চৌধুরীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ান। সেই দিনের বিবরণ,“ মিসেস চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকায় ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রচন্ড গোলাবর্ষন করেছিল। ঠিক ঐ সময়ে গায়ে কাদা মাটি মাখানো ছোট একটি মাইক্রোবাস এসে থামে মাওঃ মান্নানের দরজার সমানে। এ ধরনের গাড়ি সেখানে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতো আর তাই এতে চৌধুরী পরিবারের লোকজন তেমন বিরক্ত বোধ করেন নি। ইতোমধ্যে দু’জন অস্ত্রধারী আল বদর সদস্য ডাঃ আলিম চৌধুরীর ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। ডাঃ চৌধুরী মাওঃ মান্নানের দরজায় অনেকবার ধাক্কা দিয়েছিলেন কিন্তু মাওঃ দরজা খুলেন নি। ওই দুই বন্দুকধারী ডাঃ আলিমকে নিয়ে চলে যায়। তার পরনে ছিল সাধারণ লুঙ্গি ও গায়ে ছিল বাসায় পরা জামা”। ( শর্মিলা বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৫১ দ্রঃ)
আর ডাঃ আলিমের ভাগ্যের বিপরীত ছিল না অন্যান্য ডাক্তারদের। “মিসেস চৌধুরী মিসেস ফজলে রাব্বীকে ফোন করলে তিনি জানান, ডাঃ ফজলে রাব্বীকেও একই সময়ে একই ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ডাঃ চৌধুরীর ভাই হাফিজ ১৭ ডিসেম্বর বাসায় ফিরে আসেন।
তারা সকলে ডাঃ চৌধুরীর সন্ধান করেন কিন্তু কেউ কোন খবর দিতে পারেন নি। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর তার মরদেহ রায়ের বাজার খোলা ইটের ভাটায় আরো অনেক বুদ্ধিজীবি ও বিভিন্ন পেশাজীবীর লাশের সঙ্গে পাওয়া যায় যারা ছিলেন বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৫১-১৫২ দ্রঃ)
হত্যাকান্ডের উপর মিথ্যা রিপোর্ট কেন?
বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডগুলো ছিল নিঃসন্দেহে নির্মম এবং ভয়াবহ। কিন্তু তারপরও হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলোকে সেই সময়ে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। যা আজও চলমান আছে। এতে করে বুদ্ধিজীবিদের প্রতি অতিরিক্ত সমবেদনা আদায় হয়েছিল কিনা তা জানা না গেলেও পরবর্তিতে সত্য প্রকাশিত হবার পর বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। সে সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলিমের দু’চোখ তুলে ফেলা হয়েছিল এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফজলে রাব্বির হৃদপিন্ড কেটে বের করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু স্বয়ং ডাঃ আলিম এবং ডাঃ ফজলে রাব্বির স্ত্রী বলেন ভিন্ন কথা!
মিসেস চৌধুরীর দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী,ডাঃ আলিম চৌধুরীর বুকে অনেকগুলো বুলেটের আঘাতের ছিল এবং বাম ললাট ও বাম তলপেটে ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আঘাতের চিন্হ ছিল যা দেখে মনে হয়েছিল তাকে বেয়োনেট দিয়েও আঘাত করা হয়েছে। তার পরনে ছিল সেই গেঞ্জি, জমা আর লুঙ্গি যা পড়া অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। মিসেস চৌধুরী দেখেছিলেন যে তার মুখমন্ডল অস্বাভাবিক কালো হয়ে গেছে। কিন্তু তার চোখ অক্ষত ছিল। সে খবর টি বেরিয়েছিল যে, তার চোখ তুলে ফেলা হেয়েছিল সেটি সঠিক নয়।
ডাঃ ফজলে রাব্বির মরদেহ সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী বলেন,“ তার বাম গাল ও তার কপালের বাম পাশে ছিল অসংখ্য বুলেটের চিন্হ। বুকেও অসংখ্য বুলেটের আঘাত ছিল তবে আমি তা গুনে দেখিনি। কিন্তু এটা ডাহা মিথ্যে কথা যে তার বুক চিরে ফেলা হয়েছিল। আমি সেই বুক দু’হাত দিয়ে ধরেছি ও দেখেছি।”।( শর্মিলা বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৫২ ও ১৫৬ দ্রঃ)
তাহলে বুদ্ধিজীবিদের হত্যার বিবরন নিয়ে এই মিথ্যাচার কেন?
বুদ্ধিজীবিদের আসল হত্যাকারী কারা?
দেশ স্বাধীন হবার পর ডাঃ চৌধুরীর পরিবার মাওঃ মান্নানের উপর হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। কিন্তু মাওঃ মান্নান অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে যান। তখন মাওঃ মান্নানের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করে বলা হয়, একে ধরিয়ে দিন। মাওঃ মান্নান খন্ডকালীন সময়ে ধরা পড়লেও পরবর্তিতে অজানা কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই মাওঃ মান্নান পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তার নিজ মালিকানায় একটি সংবাদ পত্রও ছিল। এবং সবচেয়ে মজার বিষয় এই মাওঃ মান্নান পরবর্তি সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। (সূত্রঃ ডেড রেকনিং,পৃঃ১৫৪ দ্রঃ)
তাহলে প্রশ্ন হল, এই মাওঃ মান্নানকে কেন বিচারের মুখোমুখি করা হলো না?
এটা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও বিশ্বাস করা হয় যে, পাকিস্তান সেনাবহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি খান ছিলেন স্বাধীনতার সমর্থক বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকান্ডের মুখ্য পরিকল্পনাকারী। ধারণা করার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে তার লেখা বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের নামের তালিকা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশীদের হাতে পড়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকার গঠিত হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে বলা হয়েছে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড নিয়ে মেজর জেনারেল রাও ফরমান ও তৎকালীন ঢাকা জেলা প্রশাসক মেজর জেনারেল জামসেদকে জেরা করা হয়েছিল। তারা বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তালিকানুযায়ী তারা কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন। তবে মেজর জেনারেল রাও ফরমান পরামর্শ দিয়েছিলেন কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য। তাছাড়া গোযেন্দারা যে নামের তালিকা দিয়েছিল তা ছিল গেরিলা নেতাদের কোন বুদ্ধিজীবিদের নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় আক্রমন প্রতিহত করতে ব্যস্ত ছিল তাদের হাতে এতোটাও সময় ছিল না যে পরকিল্পনা করে কাউকে হত্যা করবে। (সূত্রঃ ডেড রেকনিং,পৃ,১৫৩দ্র)।
আর যদি ভাবা হয় বাঙালী পাকিস্তান পন্থিরা তাদের হত্যা করেছে তাহলে আরও কিছু কথা বলতে হয়। যুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর মুক্তিযোদ্ধারা পাইকারী হারে রাজাকার আল বদর নিধন শুরু করে। তখন বাঙাল রাজাকাররা নিজেদের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। তখন আর বদর বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যরাই ছিল পলাতক। আর এই সময়ে তাদের দ্বারা এরকম একটি প্ল্যানেড হত্যাকান্ড বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর ছিল না।( ডেড রেকনিং,পৃঃ ১৫৩-১৫৪ দ্র)
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও সেই হত্যাকান্ডের কোন তদন্ত করা হয় নি। সরকারীভাবে কোন উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। যা দেশ স্বাধীন হবার পরপরই করা উচিত ছিল। কিন্তু কেন করা হলো না???
ইতিহাসে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড নিয়ে সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে না পেলেও ইতিহাসের বুকে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম যাতে সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে প্রকাশ করে আমাদের বাধিত করেন।

বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

রোহিঙ্গা ইতিহাস নিয়ে সাতটি বিচিত্র তথ্য

রোহিঙ্গা ইতিহাস নিয়ে সাতটি বিচিত্র তথ্য

টেকনাফের অস্থায়ী শিবিরে রোহিঙ্গা শরণার্থী
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এখন বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? এখানে রোহিঙ্গা জাতির প্রায় ভুলে যাওয়া ইতিহাসের কিছু তুথ্য তুলে ধরা হলো:
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা।
আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে।
১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে।
ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।
সূত্র: রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, এন. এম. হাবিব উল্লাহ্, এপ্রিল-১৯৯৫