শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭

সিরাজুল দাদা এখন তখন

সিরাজুল আলম খান, নোয়াখালীতে ১৯৪১ সালে জন্ম নেয়া এক জন ব্যাক্তি যে বাংলাদেশের জন্মের সাথে জড়িত অত্যান্ত নিবিড় ভাবে। অবিবাহিত একজন মানুষ যাকে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে সম্মক অবহিতজনের কাছে পরিচিত রহস্যপুরুষ হিসাবে, এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তিনি পরিচিত তাত্ত্বিক (theorist) হিসাবে। সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসাবে শিক্ষায়তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে।

নিউক্লিয়াস : 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩-’৬৪ এবং ১৯৬৪-’৬৫ এই দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের সাবেক আইনমন্ত্রী জাস্টিস ইব্রাহিমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে একটি গোপন ফোরাম । এর সঙ্গে জড়িত হন সিরাজুল আলম খান, মাজহারুল হক, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, কাজী আরেফ আহমেদ প্রমুখ । '৬৫ সালে এতে আরো দু'জনকে নেয়া হয় -যশোরের ছাত্রলীগ নেতা আবদুল কালাম আজাদ আর চট্রগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা এম এ হান্নান । ৬৮,৬৯, ৭১ এ নিউক্লিয়াসের শাখা দেশের সকল জেলা মহকুমা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় । এ সময় উপদেষ্টা হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড আহমদ শরীফ এবং রাজনীতিক -রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দিন আহমেদ। (*) ক্ষুদ্রাকারে হলেও এই ফোরামই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে । আর সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটা অংশ কাজ করতে থাকে যারা পরিচিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস হিসেবে ।

নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নমেও পরিচিত। এই উদ্যোগে তাঁর প্রধান সহকর্মী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৬২-’৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১-দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’। আন্দোলনের এক পর্যযে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াসে’র রাজনৈতিক উইং বি.এল.এফ এবং সামরিক ‘জয় বাংলা বাহিনী’। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে ‘জয় বাংলা’ সহ সকল স্লোগান নির্ধারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে “...এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বাক্যসমূহের সংযোজনের কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসে’র। এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভুমিকা ছিল মুখ্য। ’৬৯-’৭০ সনে গন-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানী শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াসে’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র-ব্রিগেড, যুব-ব্রিগেড, শ্রমিক-ব্রিগেড, নারী-ব্রিগেড, কৃষক-ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী। এদের সদস্যরাএ ভেঙ্গে পডা পাকিস্তানী শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টীমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানা উৎপাদন আব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খ্লা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে। নিউক্লিয়াসের সদস্যদের দ্বারা এইসব দূরুহ কাজ সাম্পাদনের জন্য কৌশল ও পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র।

স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস বাঙ্গালীর মুক্তির আন্দোলনের নানা পর্যায়ে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রেখেছে বিশেষত নানা জয় বাংলার মত যুগান্তকারী শ্লোগান তৈরী , শেখ মুজিবিকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দান, স্বাধীন বাংলার পতাকা উদ্ভাবন -উত্তোলন, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ ইত্যাদি এবং প্রতিটি পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের ভুমিকা ছিল অনস্বীকার্য । '৬৯ এর গন অভ্যুথানের মহানায়ক বলে খ্যাত তোফায়েল আহমদ বলেন -" ১৯৬৯ এ আমি ছিলাম তোতাপাখির মতো । সবকিছু করে দিয়েছেন আমার আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু সিরাজুল আলম খান যিনি আমাকে হাতে কলমে রাজনীতি শিখিয়েছেন "।

১৯৭০-’৭১ সন নাগাদ বি.এল.ইফ এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে। এদের প্রত্যেকেই মুক্তি্যুদ্ধ চলাকালে উন্নত সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত হন এবং ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্হ ১১টি সেক্টরের পাশাপাশি ৪টি সেক্টরের বিভক্ত করে বি.এল.এফ-এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল কেবল ভিন্ন ধরনের নয়, অনেক উন্নতমানের এবং বিজ্ঞানসম্মত। বি.এল.এফ-এর চার প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আব্দুর রাজ্জক এবং তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭১ সনের ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় উদ্বোধনী সভা স্হগিত ঘোষণার পর পরই ২রা মার্চ বাংলাদেশর প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণসহ ৩রা মার্চ ‘স্বাধীন বাংলার ইশ্‌তেহার’ ঘোশণার পরিকল্পনাও ‘নিউক্লিয়াসে’র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই দুটি কাজ ছিলো প্রথম দিকনির্দেশনা। আর এই দুই গুরুদায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে আ স ম আবদূর রব এবং সাজাহান সিরাজ। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচিত করার দায়িত্ব পালন করে বি.এল.এফ। নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনে গড়ে ওঠা জনমতকে সাংবিধানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গণরায়ে পরিণত করার এই কৌশলও নির্ধারণ করে বি.এল.এফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সানন্দে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। আন্দোলন, নির্বাচন, সমান্তরাল প্রশাসন এবং আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামকে হিসাবে নিয়ে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলার কৃতিত্ব সিরাজুল আলম খানের।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে ষাটের দশকের প্রথম থেকেই বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হতে থাকে দেশের আনাচে কানাচে, যার উদ্দ্যেশ্য স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদ । এমনি একটি সংগঠন ছিল বঙ্গবাহিনী । সিরাজুল আলম খান , আহমেদ ছফা চৌমুহনী কলেজের ছাত্র শা আলম এর সাথে বঙ্গবাহীনির সদস্যদের আলাপের হয় । শেখ মুজিব প্রসংগে সিরাজুল আলম খান তখন বঙ্গবাহিনীর সদস্য ফিরোজ ও হারুন-উর-রশিদকে বলেন “শেখ মুজিব স্বাধীনতায় বিশ্বাস করুন আর না করুন , তার নেতৃত্বেই স্বাধীনতা আনতে হবে । কারন পূর্ববাংলার মানুষ শেখ মুজিবের কথা শোনে এবং শুনবে ।”

তৎকালীন রাজনীতির গতি প্রকৃতি:

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ । ১২ সেপ্টেম্বর যুদ্ধের অবসান হয় । মাত্র ১৭ দিন স্থায়ী এই যুদ্ধ অসীম গুরুত্বপুর্ণ এই জন্য যে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বহু বদ্ধমূল ধারণা ধুলিস্যাত হয়ে যায় এবং বহু সুপ্ত সত্যের দ্বার উদঘাটিত হয়ে পড়ে । এক কথায় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ , যুদ্ধের ফলাফল ও তৎজনিত উপলব্ধি পাকিস্তানের ভাঙ্গনকে ত্বরান্নিত করে । পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি এলিটদের চরম বিরক্তি ও ক্ষোভের উদ্রেক ঘটায় । বৈষম্য ,প্রবঞ্চনা, অবহেলা ও অসহায়ত্বের পটভূমিতে ক্ষুব্ধ বাঙালি এলিটরা তাদের যোগ্য স্থান আদায় করে নিতে বদ্ধপরিকর হন এবং এই ইচ্ছার রাজনৈতিক বাহন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বেছে নেন । রুহুল কুদ্দুস সিএসপি প্রমুখ একটি ৬ দফা দাবিনামা প্রণয়ন করেন এবং তা’ উপস্থাপনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন । ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও আবদুস সালাম খানের সমন্নয়ে একটি প্রতিনিধি দল লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলীয় কনভেনশনে যোগ দিতে যান।এই কনভেনশনে ( ৫ ফেব্রুয়ারী ’৬৬) শেখ মুজিব সর্বপ্রথম ৬ দফাকে 'টকিং পয়েন্ট' হিসেবে উপস্থাপন করেন । তখন থেকেই আওয়ামী লীগে দুটো ধারা দেখা দেয় ।

একটি ধারায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কেন্দ্রে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধরণ ক্ষমতা ব্যতীত অন্য সকল ক্ষমতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন । আর এক ধারায় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একটি সেল গঠিত হয়েছিল যারা পুর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার পক্ষপাতি ছিলেন । ১৯৬৬ সালের আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পেছনে সিরাজুল আলম খানের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। এদিকে ৬দফার জনপ্রিয়তা দেখে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ৮/৫/৬৬ তারিখে । সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে ৭ জুন আহুত হরতালে শহীদ হন শ্রমিক নেতা মনু মিয়া , আবুল হোসেন প্রমুখ ।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহীনি :
যুদ্ধ চলাকালীন সময় সিরাজুল আলম খান ভারতে চলে যান এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research & Analysis Wing (RAW)এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে এবং বিখ্যাত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের ট্রেনিংয়ে ১০ হাজার সদস্যের যে এলিট বাহিনী তৈরি করা হয় তা আমরা “মুজিব বাহিনি” নামে চিনি। কলকাতা ভবানীপুর পার্কের পাশে হালকা গোলাপী রংয়ের একটি দোতলা বাড়িতে রেখে মুজিব বাহিনির মাথাদের ট্রেনিং দেয়া হয়।২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোডের ‘সানী ভিলা’ নামে এই বাড়িটির মালিক প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সুতার। বাসিন্দাদের নাম তপু বাবু, রাজু বাবু, সরোজ বাবু, মণি বাবু, মধু বাবু। তপু ওরফে তোফায়েল আহমেদ, রাজু ওরফে আবদুর রাজ্জাক, সরোজ আকা সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মণি ওরফে মণি বাবু এবং বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন বা মন্টু বাবু। নয় নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ পেয়ে আসা বরিশাল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুর রহমান মোস্তফার জবানীতে : বাড়ির দোতলায় একটি কক্ষে তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাইসহ আরও কয়েকজন আমাকে নিয়ে বৈঠক করলেন। ঐ বৈঠকে বসে জানলাম, আগরতলায় শেখ ফজলুল হক মণিসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের ভারতে আগত সদস্যদের নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আগরতলাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নাকি বেশ কয়েক হাজার মুজিব বাহিনীর সদস্য ভারতের পার্বত্য দুর্গম এলাকা টেন্ডুয়াতে (তানদুয়া) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেয়া আরম্ভ করেছে।

মে মাসের শুরুতে ‘সানী ভিলা’র সেই বৈঠকে উবানকে তাদের পরিকল্পনা জানান চার নেতা। পরিকল্পনাটি তার পছন্দ হয় খুবই। মুজিব বাহিনীর গঠন এবং ট্রেনিংয়ের ব্যাপারটি পুরোটাই গোপনে ব্যবস্থা করা হয় আর এ ব্যাপারে ভারতীয় সেনা প্রধান এবং ওয়ার কাউন্সিল হেড জেনারেল স্যাম মানেকশ ছাড়া আর কেউই কিছু জানতেন না। এ কারণে মুজিব বাহিনীকে ‘স্যামস বয়েজ’ নামে উল্লেখ করতো ভারতীয় বাহিনী। উবান জানাচ্ছেন পরে তাজউদ্দিনকে মানেকশ সরাসরি বলেছেন যে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য তিনি (মানেকশ) নিজেই গড়ে তুলেছেন এই বাহিনী। তিব্বতীদের নিয়ে গড়া স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সফল রূপকার উবানকে দায়িত্বটা দেওয়া হয় উপর মহল থেকে। র’ প্রধান আরএন কাও যিনি একই সঙ্গে ভারতীয় কেবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সচিবও ছিলেন এই ক্ষেত্রে উবানের ইমিডিয়েট বস। সে মাসেই (২৯ মে, ১৯৭১) ২৫০ জনের প্রথম দলটি দেরাদুনের দেড় কিলোমিটার দূরে পাহাড়ী শহর তানদুয়ায় প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। মেঘালয়ের হাফলংয়ে আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়, কিন্তু একটি ব্যাচ এখানে ট্রেনিং নেয়, তারপর ক্যাম্পটি তুলে নেওয়া হয়। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণে ছিল ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে উল্লেখ্য মেজর মালহোত্রা যিনি পরে রক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষনেও দায়িত্ব পালন করেন।
অন্য একটি সুত্রমতে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এক লক্ষ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়। ওসমানী 'রাজনৈতিক সচেতন' ছেলেদের রিক্রুট করারঅধিকার দিয়ে এপ্রিল মাসে রাজ্জাক, তোফায়েলকে 'অথোরাইজেশন লেটার' দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে রিক্রুটিং ছাড়াও তাদের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন, এর ট্রেনিং ও পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন। এসব সুযোগ গ্রহণকরে তারা 'মুজিব বাহিনী' নামে আলাদা একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। ভারতে এসে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান 'আট দিকপাল' গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এ্যান্ড এনালাইসিস উইং (জঅড) -এর বিশেষ সমাদর লাভ করেন। 'র'-এর সাথে প�র্বে থেকেই তাদের, বিশেষ করে শেখ মণির 'লবি' ছিল বলে শোনা যায়।
উত্তর প্রদেশের দেরাদুনস্থ টানডাওয়া ও আসামের হাফলং -এ মুজিববাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ, বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক সহ যাবতীয় রসদের যোগান 'র'-এর মাধ্যমে দেয়া হত। জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত্ম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু ছিল। প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশল প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। ভারত-সরকার মুজিববাহিনী গঠন-সংক্রান্ত্ম সিদ্ধান্ত্ম মুজিবনগর সরকারের কাছে গোপন রাখে। প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে 'প্রথম দল' বেরিয়ে আসলে এদের নামকরণ হয় 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স', পরে মুজিববাহিনী। তখনই জানা যায়, এরা আলাদা কমান্ডে চলবে; সশস্ত্রবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী, এমনকি বাংলাদেশ সরকারেরও এদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এরা সরকার নয়, শেখ মণির প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে।
মুজিববাহিনীর নেতারা দাবি করেন ১.সশস্ত্রবাহিনী গড়ে-তোলার ব্যাপারে একমাত্র তারাই শেখ মুজিবের মনোনীত প্রতিনিধি ২. আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে তারাই বিকল্প নেতৃত্ব দেবেন। ৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো কারণে দীর্ঘায়িত হলে এতে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে, তাহলেও এদের মোকাবেলায় পাল্টা শক্তি হবে এই মুজিববাহিনী। ভারত সরকার সম্ভবত 'এক বাক্সে সকল ডিম না-রাখার' জন্য মুজিববাহিনী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত্ম নেয়। উলে−খ্য বিএসএফ-এর প্রধান রুস্ত্মমজি মুজিববাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত্ম গ্রাহ্য হয়নি। মুজিব বাহিনী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দেশের অভ্যন্ত্মরে প্রবেশ করে। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে ওরা 'মুক্তিবাহিনীর' অস্ত্র কেড়ে নেয়া ও আনুগত্য পরিবর্তন করানো, অন্যথায় তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াতে অধিক সক্রিয় ছিল।
এ সব নিয়ে আওয়ামী লীগেও অসন্ত্মোষ দেখা দেয় এবং ২১ ও ২৭ অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত দু'টি সভায় আবদুল মমিনতালুকদার, শামসুল হক, নুরুল হক, আবদুল মালেক উকিল, এম এ. হান্নান প্রমুখ নেতা প্রকাশ্যে মুজিববাহিনীর কার্যকলাপ সম্ঙ্র্কে অভিযোগ তোলেন এবং এ বাহিনীকে এক কমান্ডের অধীনে আনার জোর দাবি করেন। ওসমানী আগস্ট মাসে রিক্রুটিং-এর জন্য এর নেতাদের প্রদত্ত্ব 'প্রাধিকার' প্রত্যাহার করেন এবং মুজিববাহিনীকে শিঘ্রই তাঁর কমান্ডের অধীনে না দেওয়া হলে পদত্যাগের হুমকি দেন। কিন্তু এসবের কিছুই কার্যকরী হয়নি। উপরন্তু তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরাতে না-পেরে তারা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং কমান্ডো প্রেরণ করে। উপায়ান্ত্মর না দেখে তাজউদ্দিন ২২ অক্টোবর এ-বিষয়ে মুজিববাহিনীর সমর্থক সৈয়দ নজরুলের উপস্থিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধী ডিপি ধরকে এ-বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন এবং সে মোতাবেক কলকাতায় একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য সে বৈঠক ভেস্তে যায় মুজিব বাহিনীর নেতাদের ঔদ্ধত্যপূর্ন আচরনের জন্য। 

এক পর্যায়ে মুজিববাহিনীর অভ্যন্ত্মরেও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শেখ মণি সংগঠক, সিরাজুল আলম খান তাত্ত্বিক। এ দুইয়ের সমন্বয়ে মুজিববাহিনী। কিন্তু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে শেখ মণির প্রতি বাহিনীর আনুগত্যের অঙ্গীকারের বিরোধী হন সিরাজুল আলম খান। শুরু হয় দুজনের ব্যক্তিত্বের লড়াই। এ সবের মধ্যদিয়েই সময় এগিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অনুগত মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ঢাকা তখন এদের প�র্ণ নিয়ন্ত্রণে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মধ্যদিয়ে পথ নির্ধারিত হওয়ায় মুজিববাহিনীর ঢাকা পৌঁছাতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। আর ততক্ষণে রচিত হয়ে যায় বিজয়ের ইতিহাস, নির্ধারিত হয়ে যায় যার যার ভূমিকা। ২৬ ডিসেম্বর জেনারেল ওবান ঢাকা পৌঁছান। এদিনই শেখ মণি মুজিববাহিনীর অস্ত্মিত্ব বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। বিলোপ না করে কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ কুমিল−া (মাখনের এলাকা) ব্যতীত সারাদেশে মুজিববাহিনীর সদস্যরা ততদিনে'শপথ ভঙ্গ করে' সিরাজুল আলম খানের অনুগত হয়ে পড়ে।

৭১ পরবর্তী : 

ছাত্রলীগের ষাটের দশকের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সিরাজুল আলম খান রাজনৈতিক পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে, শেখ ফজলুল হক মণি সবসময় কতিপয় তরুণ আওয়ামী লীগারদের নিয়ে দল পরিবৃত্ত হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। মুজিবের ভাগ্নে হিসেবে তিনি সর্বত্র প্রাধিকার দাবি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় 'মুজিবনগর সরকার' কর্তৃক কোনোরূপ প্রাধিকার না পাওয়ায় তিনি বিক্ষুব্ধ ছিলেন এবং সেজন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে কোনোরূপ সহায়তাতো করেনই নি বরং সব কাজে বিরোধিতা করেছেন।

স্বাধীনতার পর ২১ মে ১৯৭২ প্রথম ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের 'চার খলিফা' এবং তাদের সমর্থক বিলুপ্ত মুজিববাহিনীর সদস্যরা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিদ্দিকী-মাখনের দল শেখ মণি এবং রব-সিরাজের দল সিরাজুল আলম খানের আর্শীর্বাদ লাভ করে। কিন্তু উভয় দলের প্রার্থীই ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীদের নিকট পরাজয় বরণ করে। অল্পদিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেও ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের নিকট পরাজিত হয়। এরপর সারাদেশে স্কুল-কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের জয়ের হিড়িক পড়ে যায়। উপর্যুপরি এই পরাজয় ছাত্রলীগের মধ্যকার 'আতঙ্ক, ক্রোধ ও আক্রোশ' আরও বাড়িয়ে দেয়। উভয় দল মুজিবের সমর্থন লাভের আশায় নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। ২০-২৩ জুলাই ১৯৭২ আহ�ত হয় ছাত্রলীগের উভয় দলের জাতীয় সম্মেলন। সিদ্দিকী-মাখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও রব-সিরাজ পল্টন ময়দানে সম্মেলনের মঞ্চ স্থাপন করে।

উভয় দলের পোস্টারে প্রধান অতিথি/ উদ্বোধকহিসেবে শেখ মুজিবের নাম প্রচার করা হয়। শত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যোগ দেন। আনন্দে উল−সিত কর্মীরা 'স্বাধীনতা এনেছি, মুজিববাদ আনব' স্লোগানে সম্মেলনস্থান মুখরিত করে তোলে। স্বভাবত এরাই মুজিববাদ কায়েমের অধিকার পায়। সম্মেলনে শেখ শহিদুল ইসলামকে সভাপতি ও এম. এ. রশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে 'মুজিববাদী' ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়। অপরদিকে, পল্টনে সম্মেলন আয়োজনকারীরা মুজিবকে নিতে ব্যর্থ হয়ে তাঁর বিকল্প হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছাত্রলীগ নেতা স্বপনের পিতাকে দিয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করায়। এরা মুজিববাদের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য ঘোষণা করে। আফম মাহবুবুল হককে সভাপতি ও শরীফ ন�রুল আম্বিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় এ-দলের কমিটি। দুটি ভিন্ন স্থানে সম্মেলন অনুষ্ঠান ও দুটি কমিটি করার মধ্যদিয়ে ছাত্রলীগের বিভক্তি চূড়ান্ত্ম হয়। দু-দলের সংঘর্ষে প্রাক্তন নেতা আবদুর রাজ্জাক ও আসম আবদুর রব সহ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। সংঘর্ষ ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে শেখ মণি ও সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিত্বের সংঘাত প্রথমে নেতৃত্বের কোন্দলে ও পরে আদর্শগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়।

বিশেষজ্ঞ মহল এই বিভক্তিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিষবৃক্ষের অঙ্কুরোদগম বিবেচনা করে শঙ্কিত হন। অথচ মুজিব কেন এ কলহ মিটিয়ে না দিয়ে ডাকসুতে দুটি প্যানেল হতে দিলেন বা ছাত্রলীগের দুটি সম্মেলন হতে দিলেন অথবা নিজে একাংশের সম্মেলনে যোগ দিয়ে বিভক্তির আগুনে ঘৃতাহুতি দিলেন তা কারও বোধগম্য হয়নি। দিন যত যাচ্ছিল, দেশে সমস্যা তত বাড়ছিল।

সেই সাথে কমছিল আওয়ামী লীগ ও মুজিবের জনপ্রিয়তা। আওয়ামী-পরিবারের একাংশ দল ছেড়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে জাসদ গঠন করলে তা হয়ে উঠে মুজিব-বিরোধীদের কণ্ঠস্বর ও আশ্রয়কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অনুমোদিত রাজনৈতিক দল হচ্ছে 'জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল' বা জাসদ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টেবর মেজর আব্দুল জলিলকে প্রেসিডেন্ট এবং আসম রবকে সাধারণ সম্পাদক করে আত্মপ্রকাশ ঘটে নতুন এই রাজনৈতিক দলটির। এই দলের অধিকাংশ নেতারাই ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর ছাত্রলীগ তথা ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতারা। তাঁদের মধ্যে শাজাহান সিরাজ, মরহুম কাজী আরেফ আহমেদ, মঈনুদ্দিন খান বাদল, মরহুম নুরে আলম জিকু, আব্দুল মালেক রতন, হাসানুল হক ইনু, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, মাহবুবুল হক, সৈয়দ শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাফর সাজ্জাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এরা সবাই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। জাসদ প্রতিষ্ঠালগ্নের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান । 

এই নতুন দল ও এর রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগে বিভক্তি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের স্লোগান ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিজয়ী ছাত্র-ইউনিয়ন নানা কারণে তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি, উপরন্ত সরকারের 'বি-টিম' হিসেবে আখ্যায়িত হয়।

১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দেয়। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। নির্বাচনে পরাজয়ের সম্ভাবনা অনুমান করে কতিপয় শস্ত্রপাণি ছাত্রলীগ কর্মী শহীদুল্লাহ হল সহ কয়েকটি হলের ব্যালটবাক্স ছিনতাই করে। নির্বাচনের ফলাফল কেড়ে নেয়ার শিক্ষা তারা পেয়েছিল ম�ল দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই,৭ মার্চের (১৯৭৩) প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে থাকলে সারাদেশ দখলে থাকবে' তত্বে বিশ্বাসী হয়ে মোনায়েম খান উপাশ্চার্য ওসমান গনির সহায়তায় এন এস এফ-কে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে রাখার চেষ্টা করে। ছাত্রলীগও ঐ দখল-তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ব্যালট ছিনতাই করে জয়ী হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

জাসদের রাজনীতি :
মনে করা হয়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ সৃষ্টি রহস্য নিহিত রয়েছে মুজিব বাহিনীর মতই ভারতের মাটিতে। কেননা, তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যু্ক্ত হয়ে ভারতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্যান্য প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জয় প্রকাশ নারায়ণ, ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী ‘র’ প্রধান জেনারেল উবান ও আরও কিছুসংখ্যক নেতার সাথে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগলাভ করেন, একাধিক বিষয়ে মতবিনিময় করেন এবং প্রকারান্তরে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদকেও উপেক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর জাসদের অনেক নেতাই সেদিন আত্মগোপন করেন বা পলাতক থাকেন, পরে সুযোগ বুঝে আবার ফিরেও আসেন।আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে এই জাসদও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর জাসদের গণবাহিনী প্রধান কর্ণেল তাহের, সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনু হন্তারক ও দখলদার বাহিনীর সাথে রেডিও বাংলাদেশ, টেলিভিশন, গণভবন, ক্যান্টনমেন্ট প্রভৃতি জায়গায় যান, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে আনুগত্য স্বীকার করেন।
জাসদের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হয়েছিল, তৎকালীন (আওয়ামী লীগ) সরকারের দমন-পীড়নের কারণে তারা প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন বাদ দিয়ে গোপন ও সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের এই যুক্তি যে সঠিক নয়, তা জাসদের পরবর্তী দলিলেও স্বীকার করা হয়েছে।

তাত্ত্বিক জীবন :
১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লবই এযাবৎ জাসদের সবচেয়ে আলোচিত, বিতর্কিত এবং বিভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপ। কোনো কোনো জাসদ নেতার দাবি, ‘সেদিন তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করতে গেলে রক্ষীবাহিনী/পুলিশ তাঁদের ওপর গুলি চালায়।’ এছাড়া ১৯৭৫ এর ২৬ নবেম্ভর ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরনের চেষ্টা কালে ৪ জন দুষ্কৃতকারী নিহত ও ২ জন আহত হয় । পরে জানা যায় তারা জাসদকর্মী ছিল।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে জাসদ ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার’ গঠন করতে চেয়েছিল। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও তারা হাল ছাড়েনি। ১৯৮০ সালে ঘোষিত হয় ১৮ দফা কর্মসূচি, যাতে আরও গণতন্ত্র, ২০০ আসনের পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বসহ ৫০০ আসনের পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।।

৭ মার্চ ১৯৭৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রমনের ঘটনার পর জাসদের যে 'পার্টি থিসিস' উত্থাপিত হয় তাতে 'রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন' করার কথা বলা হয় এবং সে-ধারাতেই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ 'সিপাহী বিদ্রোহ' ঘটে।

জনাব খান এখন বছরের অধিকাংশ সময় বিদেশী প্রভাবের ম�ল কেন্দ্র 'স্বপ্নের' অ্যামেরিকায় প্রবাসে থাকেন এবং বিপ−ব ভুলে (সে সমাজতান্ত্রিকই হোক আর 'জাতীয় গণতান্ত্রিকই' হোক) 'মুজিবের' বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর গবেষণা করে ও গ্রন্থ লিখে সময় কাটান। তিনি বছরের যে সামান্য সময় বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন, তার অধিকাংশই ব্যয় করেন পাঁচতারা হোটেলে (সোনার গাঁ/শেরাটনে) রব-সিরাজ বা অন্যান্য সাবেক 'বিপ−বী' পরিবেষ্টিত হয়ে আড্ডা দিয়ে। লক্ষণীয়, এত কাল পরও 'বিপ−ব স্ঙ্ন্দিত' হয়ে রাখা শ্মশ্রু ও দীঘল কেশ শোভিত হয়ে মার্ক্সের অবয়ব ধারণ করে এবং অকৃতদার থেকে তিনি বিপ−বী ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত্ম হয়ে আছেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, 'যাকে আজকাল ভগবান রজনিশের মতো দেখায়। সুতরাং আর কী চাই?