সোমবার, ১৮ মে, ২০২০

শমসের গাজী||এক হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবী নায়ক ||ফেনীর ইতিহাস পর্ব(১) -সংগ্রহ ও সম্পাদনা জাকির রুবেল

শমসের গাজী এক হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবী নায়ক


দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়টাতে বিস্ময়করভাবে উত্থান ঘটে এক বিল্পবীর। যিনি সফলভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন মগ-পর্তুগীজ-হার্মাদ জলদস্যুদের। যে সময়টায় শাসকদের সাথে প্রজাদের সম্পর্ক ছিল খাজনা দেওয়া-নেওয়া আর অত্যাচারের, সেই সময়টাতে জমিদার হয়ে তিনি নিজ প্রজাদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপের সামন্ত প্রভু ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে! অত্যাচারী বিক্রমশালী ত্রিপুরা রাজকে কৃষক-জনসাধারণের সহায়তায় পরাজিত করে গঠন করেছিলেন নিজ রাজ্য। ফেনীর এক হতদরিদ্র ঘরের সন্তান থেকে বীরত্ব আর ‍রাজনৈতিক মেধায় অধিপতি হয়েছিলেন বিশাল এক ভূখণ্ডের। নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ও ত্রিপুরা রাজ্যের নানা জায়গার নামকরণ আর নানা কেচ্ছা-কাহিনীতে নানাভাবে জড়িয়ে আছে তার নাম। তিনি শমসের গাজী। অকুভোতয় বীরত্বের জন্য যাকে ডাকা হয় 'ভাটির বাঘ'!


ফেনীর চম্পকনগর ছিল শমসের গাজীর রাজধানী

ত্রিপুরা রাজবংশকে উচ্ছেদ করার পর শমসের গাজী আগরতলা থেকে উদয়পুরে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে তার শাসন পরিচালনা করতেন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলাধীন রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত চম্পকনগর গ্রাম থেকে।
ফেনীর  শুভপুর বাজার থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে  চম্পকনগর গ্রাম। এই চম্পকনগরেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দরবার হল, অস্ত্রাগার সহ তার বিশাল আবাসস্থল। এখানে  তার বাসস্থানের স্মৃতি চিহ্ন এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। কিছু ধ্বংসাবশেষ, যেমন প্রাসাদের নিরাপত্তার জন্য খনন করা গড়খাই (খন্দক),  রাজপ্রাসাদের মাঝখানে তৈরি এককুল্লা দীঘি, পাহাড় কেটে তৈরি সুড়ঙ্গ পথ ইত্যাদি টিকে আছে এখনো। তবে তার বাড়ি ও দিঘীর বড় অংশই রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলের সীমানায়।


শমসের গাজীর শৈশব

শমসের গাজীর জন্ম নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কারো মতে ১৭০৫ কিংবা ১৭০৬ সালে, আবার কারো মতে ১৭১২ সালে বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা গ্রামে। তার পিতা পীর মোহাম্মদ তৎকালীন ওমরাবাদ পরগনার একটি কাছারিতে খাজনা আদায় করতেন। তার মায়ের নাম কৈয়ারা বেগম। আর্থিক অনটনের কারণে ভাগ্য অন্বেষণে শমসের গাজীর পিতা চাকরি ছেড়ে বেদরাবাদ এলাকায় সস্ত্রীক চলে আসেন এবং এখানেও নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়লে স্থানীয় জমিদার নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন। সেই বাড়িতেই জন্ম শমসের গাজীর। শৈশবেই  পিতাকে হারানোর ফলে শমসের অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হন।
কথিত আছে, একদিন মায়ের বকুনি শুনে ফেনী নদীর তীরে বসে কান্না করার সময় সে পথ ধরে নিজামপুর থেকে ধনুঘাট হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন ও তার  স্ত্রী সোনা দেবী । তালুকদার সাহেবের সন্তান ছিল না বলেই হয়তো শমসের গাজীর প্রতি দুর্বল হয়ে তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে যান। তারপর থেকে জগন্নাথ সেনের স্নেহ-মমতায়ই বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের। বড় হওয়ার সাথে সাথে লাঠি, কুস্তি, তলোয়ার কিংবা তীর-ধনুক চালনা সব ক্ষেত্রেই শমসের পারদর্শীতা শমসের গাজীকে চারদিকে পরিচিতি এনে দেয়।


শমসের গাজীর উত্থান

তালুকদার জগন্নাথ সেনের ইন্তেকালের পর শমসের গাজী শুভপুর কাছারির খাজনা আদায় ও নানাবিধ কাজের তদারকি করতে থাকেন। সেই সময়ে মহুরী নদীর তীরে পানুয়াঘাট নামক একটি কেল্লা ছিল। ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলে এখনো সে ঘাটের নাম মানুষের মুখে মুখে ফেরে, বলা হয়-
দিঘির মধ্যে জগন্নাথ
পাড়ের মধ্যে বীরসিংহ
পানির মধ্যে কৈয়ারা
হাটের মধ্যে লেমুয়া
ঘাটের মধ্যে পানুয়া।
শমসের গাজীর শৌর্য-বীর্য তখন চারদিকে বিদিত। এই সময় জমিদার নাছির মোহাম্মদ তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে গাজীকে পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় শমসের গাজীর ‍উত্থানের গল্প।
দক্ষিণ বাংলার এ অঞ্চলটি তখন মগ, পর্তুগীজ, হার্মাদ জলদস্যুদের কাছে জিম্মি তো ছিলই, উপরন্তু পানুয়াঘাটেই প্রায় পাঁচ শতাধিক চোর ডাকাতের একটি শক্তিশালী দল এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
শমসের গাজী তখন ত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। পানুয়াঘাটের কেল্লা প্রধান হয়েই তিনি মগ, পর্তুগীজ এবং স্থানীয় দস্যুদের সাফল্যের সাথে বিতাড়ন করেন। এই সাফল্য তাকে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।



একটি ব্যর্থ প্রেম ও কাহিনী ও দুঃখজনক অধ্যায়

শমসের গাজীর উত্থানের পেছনে জমিদার নাছির মোহাম্মদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি শমসের গাজীকে খুবই স্নেহ করতেন। শমসের গাজীর পিতাকেও তিনিই আশ্রয় দিয়েছিলেন। পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ হিসেবে তিনিই শমসের গাজীকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শমসের গাজী নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়া বিবিকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে সব সমীকরণ উল্টে যায়।
নাছির মোহাম্মদ খুবই অপমান বোধ করেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে গাজীকে কেল্লা প্রধানের পদ থেকে বহিষ্কার করেন। সেই সাথে তাকে ধরে আনার জন্য সৈন্যও পাঠান।
শমসের গাজী এত সহজে হেরে যেতে রাজি ছিলেন না। তিনি ও তার চাচাত ভাই ছদু পালোয়ান জমিদারের সৈন্যদের পরাজিত করে সেখান থেকে সরে পড়েন ও পার্শ্ববর্তী বেদারাবাদ এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন।
এর কিছুদিনের মধ্যেই জমিদার নাছির মোহাম্মদ শমসের গাজীর চাচাত ভাই ছদু পালোয়ানের হাতে নিহত হন। যদিও শমসের গাজী এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেননি বলেই মনে করা হয়, তথাপি কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাছির মোহাম্মদের পুত্রদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এবং তাদের হত্যা করে নাছির মোহাম্মদের জমিদারী নিজের দখলে নেন। এ প্রসঙ্গে গাজীনামায় কবি বলেন,
অন্দরে আছিল যত ধন বস্ত্র দ্রব্য।
অনলে দহিল আর গাজী নিল সর্ব্ব।।
হাতি-ঘোড়া, তোষা জোড়া আর যত মাল।
গাজী ছাদু নিয়া গেল আপন মহাল।।
নাছির মোহাম্মদ ও তারপর তার পুত্ররাও নিহত হওয়ার পর তাদের অনুগত সৈনিকরা অধিকাংশই পালিয়ে যায় আর কিছু শমসের গাজীর পক্ষেও যোগ দেয়। তবে যার জন্য এত কিছু, নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়া বিবিকে তিনি পেয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মন্তব্য পরস্পরবিরোধী। তবে কুমিল্লা অঞ্চলের দৈয়া বিবির হাট আজো কালের স্বাক্ষী হয়ে জানান দিচ্ছে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাসের।


ত্রিপুরা বিজয়

শমসের গাজী সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার রাজনৈতিক মেধা ও দূরদৃষ্টি ছিল অসাধারন। তিনি জমিদারি দখল করে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেননি, বরং ত্রিপুরা রাজের সাথে সংঘর্ষ নিশ্চিত ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনি দ্রুতই প্রজাদের সাথে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি শুধু ক্ষমতা কিংবা লোক দেখানোর জন্য নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই মানুষের দুর্দশা দূর করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আর সে কারণেই জনগণও তার প্রতিদান দিতে ভোলেনি। শমসের গাজীর সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক ছিলেন তার কৃষক-প্রজাগণ!
যা-ই হোক, শমসের গাজী গোপনে রণ প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বিশাল ভবন নির্মাণ করে তার চারপাশে প্রায় ৫০ গজ প্রশস্ত পরিখা খনন করেন, নিয়োগ করেন সশস্ত্র প্রহরী।
কৃষ্ণ মাণিক্য  তখন ত্রিপুরার রাজা। নাছির চৌধুরীরর পতনের পরই তার অংশীদার রতন চৌধুরী ত্রিপুরার কৃষ্ণ মাণিক্যের কাছে  অভিযোগ করলে ত্রিপুরারাজ উজির জয়দেব ও সেনাপতি লুচি দর্পনারায়ণকে পাঠান শমসের গাজীকে পরাস্ত করতে। শমসের গাজী প্রমাদ গুনলেন, যদিও তিনি গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যুদ্ধের জন্য, কিন্তু তা ছিল কেবল শুরু। উজির জয়দেব ও সেনাপতি দর্পনারায়ণ তিন হাজার সৈন্যসমেত ছাগলনাইয়া কেল্লায় উপস্থিত হলে শমসের গাজী সুকৌশলে উজির জয়দেবকে নিজ কব্জায় নিয়ে আসেন। উজিরের বন্দী হওয়ার খবর শুনে সেনাপতি দর্পনারায়ণ সৈন্যসমেত পালিয়ে যান।
শমসের গাজী উজিরকে কার্যত বন্দী করলেও তাকে মেহমানদারী করে নিজের বশে আনেন আর দক্ষ রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে উজিরের মুক্তির বিনিময়ে ত্রিপুরারাজের কাছ থেকে দক্ষিণ শিকের জমিদারিও লিখে নেন। জমিদারী লিখে নেওয়ার পর শমসের গাজী থেমে যাননি। তিনি একদিকে ত্রিপুরারাজের সাথে সখ্যতা বজায় রাখছিলেন, অপরদিকে নিজেও প্রস্তুতি নিচ্ছিলিন নিজের মতো করে।
জমিদার কিংবা শাসক হিসেবে শমসের গাজী প্রজাদরদী শাসক ছিলেন। কৃষক-শ্রমিকদের তিনি ভালোবাসতেন এবং জমিদার হয়েও তাদেরকে ভুলে যাননি কিংবা দূরে সরিয়ে দেননি।
জমিদারির প্রথম দিকেই পাহাড়ি ঢালে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় তিনি কৃষকদের খাজনা মওকুফ করে দেন। যদিও তার জমিদারীর প্রথম তিন বছরে দশ হাজার মুদ্রা খাজনা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি কানাকড়িও তিনি ত্রিপুরারাজকে প্রদান করেননি।
খাজনা না দেওয়াকে কেন্দ্র করে শমসের গাজী ও ত্রিপুরার রাজার মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। আর শমসের গাজীও যুদ্ধের জন্যই এতদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ত্রিপুরার রাজদরবার তখন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রীতিমতো দুর্বল। শমসের গাজীও ঠিক এই সময়টিই বেছে নেন যুদ্ধের জন্য।

ত্রিপুরারাজ শমসের গাজীকে শায়েস্তা করতে সেনাবাহিনী পাঠান। ত্রিপুরা রাজার সৈন্যরা খণ্ডলের কিল্লা এলাকায় অবস্থান নিয়ে লুটতরাজে লিপ্ত হয়। গ্রামবাসী ও কৃষকরাও ত্রিপুরা রাজার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তারা রাজার সৈন্যদের কাছে খাদ্যশস্য বিক্রয় বন্ধ করে দেয়। ফলে ত্রিপুরা রাজার সৈন্য শিবিরে শুরু হয় খাদ্য সংকট। শমসের গাজী ও তার চাচাতো ভাই ছাদু পালোয়ান এই সময় চালান প্রাণপণ আক্রমণ। তুমুল আক্রমনে ত্রিপুরা রাজের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দেয়।
শমসের গাজী ও ছাদু পালোয়ান রাজার সৈন্যদের তাড়া করে রাজধানী পর্যন্ত নিয়ে যান। এ বিষয়ে আজো কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে কাউকে শাসাতে প্রবাদ হিসেবে বলা হয়, “এক্কেরে দোম্বাই উদেপুর নিমোগোই!” অর্থাৎ “দৌড়িয়ে উদয়পুর নিয়ে যাব!”
এ প্রসঙ্গে গাজীনামায় মনোহর শেখ বলেন,
সামান্য গাজীর সনে না জিনিল রণে।
হেন অপমান বল সহিবে কেমনে।।
রাজারে তাড়ায়ে যায় রাজধানী তক।
এহতে লজ্জা কিবা আছে সমধিক।।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় তিন সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয়। ত্রিপুরা রাজার সহায়তায় মনিপুরি সৈন্যরা এগিয়ে আসলেও শমসের গাজীর বীরত্বের কাছে কেউই টিকতে পারেনি।  ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য আগরতলা ছেড়ে মনিপুরের দিকে পলায়ন করেন। আগরতলা থেকে সিলেটের মনু নদী পর্যন্ত শমসের গাজীর সীমানা বিস্তৃত হয়।


শুধু বিজয়ী নন, ছিলেন কৌশলীও

শমসের গাজীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। তিনি শুধু তরবারির জোরে রাজ্য শাসন করতে চাননি। ত্রিপুরা জয়ের পর তিনি অনুমান করেছিলেন, ত্রিপুরাবাসী তাকে বহিরাগত হিসেবে চিন্তা করতে পারে। তাই তিনি নিজে সিংহাসনে বসা থেকে বিরত থাকেন। তারচেয়ে বরং লক্ষণ মানিক্য নামক রাজপরিবারের এক সদস্যকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি অন্তরালে থেকে সব নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল গ্রহন করেন।
প্রথমদিকে যদিও কৃষ্ণমাণিক্য অর্থের বিনিময়ে ত্রিপুরার কুকি আদিবাসীদের শমসেরের বিরুদ্ধে লড়তে রসদ যোগান, কিন্তু প্রতিবারই কুকিরা শমসের গাজীর নিকট পরাজিত হয়। শমসের গাজী নিজ প্রজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কুকিদের বুঝিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে সফল হন। কুকিরা গাজীর উদার মনোভাব, প্রজাদের প্রতি দরদ ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কারণে গাজীকে রাজা হিসেবে মেনে নেয়। শুধু কুকিরা নয়, ত্রিপুরারাজের বহু অমাত্য, যেমন- উজির রামধন, উত্তর সিংহ, সেনাপতি রণ মর্দ্দন নারায়ণসহ অনেকে গাজীর বশ্যতা শিকার করেন ও তার পক্ষে নানা দায়িত্ব পালন করেন।

সাফল্যের অন্যতম নায়ক সাদুল্লাহ বা ছাদু পালোয়ানের সাথে বিবাদ

শমসের গাজীর সাফল্যের প্রধানতম সহযোগী ও ছোটবেলা থেকে সুখ-দুঃখের আজন্ম সাথী ছিলেন ছাদু পালোয়ান। কোনো কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। নিজ ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করে শমসের কৌশলে ছাদু পালোয়ানকে হত্যা করেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী বন্ধু হারিয়ে তিনি নিজেও শক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়েন, যা তার জন্য মোটেই সুখকর হয়নি।

শমসের গাজীর মৃত্যু, একটি নক্ষত্রের পতন

এ বিষয়ে সকলেই একমত যে শমসের গাজী স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেনননি, তবে ঠিক কীভাবে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
অনেকে মনে করেন, পলাশীর যুদ্ধের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইংরেজদের রোষানলের শিকার হন তিনি। ইংরেজরা প্রথমত তাকে দস্যু হিসেবে অপপ্রচার চালায়, অতঃপর ত্রিপুরারাজের সহায়তায় সুদক্ষ ইংরেজ বাহিনী প্রেরণ করে তাকে বন্দী ও  হত্যা করে। এই হিসেবে ১৭৬০ বা ১৭৬১ সালে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়। রাজমালা এবং ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফর কিংবা মীর কাশেমের শাসনকালে এবং তাদের নির্দেশেই শমসের গাজী নিহত হন।
তবে এই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। গাজীনামা বিবরণ অনুযায়ী, শমসের নিজামপুর পরগনার জমিদার আগা বাকেরের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আগা বাকের নবাব সিরাজের আস্থাভাজন ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবার থেকে আমন্ত্রণ এলে শমসের গাজী নবাব সিরাজের সাথে দেখা করে আসার পথে আগা বাকেরের পুত্র আগা সাদেকের বাহিনী কর্তৃক বন্দী হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। গাজীনামার লেখক মনোহর শেখের বিবরণ অনুযায়ী-
এগারশ উনষাইট সন জৈষ্ঠ্য মাসে।
জুম্মাবারে জান তুমি জোহরের শেষে।।
উনত্রিশ তারিখ সেই ছিল শুক্রবার ।
চলিল পশ্চিম মুখে গাজি মরিবার।।
কাজী মোজাম্মেল হকের লেখা তিন হাজার বছরের নোয়াখালী গ্রন্থেও আগা বাকের ও জসারত খাঁর ঘড়যন্ত্রে শমসের গাজী মুর্শিদাবাদ হইতে রংপুরের ঘোড়াঘাটে নীত হয়েছিলেন এবং সেখানেই তাকে হত্যা করা হয় বলে মত দেন। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে যদিও সব ঐতিহাসিক এখনো একমত নন। তবে আগা বাকেরকে শমসের গাজীর হত্যাকারী ধরে নিলে আগা বাকেরের শাসনকাল ও গাজীনামায় উল্লিখিত ঘটনার বিবরণ অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে ১৭৫২ থেকে ১৭৫৪ সালের মধ্যেই শমসের গাজী নিহত হয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ ১৭৫৪ সালেই মির্জা আলী নকীর আক্রমণে আগা বাকের নিহত হন ও আগা সাদেক পালিয়ে যান। আহমদ মমতাজের লেখা শমসের গাজী গ্রন্থেও ১৭৫৩ সালেই শমসের গাজী মৃত্যুবরণ করেন বলে মত পাওয়া যায়।


শমসের গাজীকে নিয়ে সমালোচনা

ঐতিহাসিকগণ নানাভাবে তার চরিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন। কারো মতে, তিনি ন্যায়পরায়ণ, দূরদর্শী, প্রজাদরদী শাসক, আবার কারো চোখে ডাকাত, অর্থলোলুপ এবং অকৃতজ্ঞ একজন মানুষ। কেউ কেউ আবার ডাকাত হিসেবে দেখলেও তার মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য তাকে দেখেন রবিনহুডের মতো মহান ব্যক্তি হিসেবে। তবে অনেক ঐতিহাসিক তার বিরুদ্ধে আনা অধিকাংশ অভিযোগগুলোকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন।
কথিত আছে, পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে এই এলাকার চোর–ডাকাতের দলটি প্রমাদ গোনে। তারা একত্র হয়ে শমসের গাজীর কাছে এই মর্মে আপোষ প্রস্তাব নিয়ে আসে যে, শমসের গাজীর সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। এখন থেকে তারা পানুয়াঘাট এলাকায় আর কোনো ডাকাতি করবেই না, বরং বাইরের এলাকা থেকে যে ডাকাতি করবে, তারও অর্ধেক গাজীকে দিতে রাজি হয়। এছাড়াও সবসময় গাজীর পাশে থাকবে বলে অঙ্গীকার করে।
সমালোচকগণ অভিযোগ করেন, শমসের গাজী ডাকাতদের সাথে সন্ধি করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করতেন এবং এছাড়াও বিভিন্ন সময় পাশ্ববর্তী জমিদারদের উপর আক্রমণ পরিচালনা, লুন্ঠন ও তার অাশ্রয়দাতা নাছির মোহাম্মদকে হত্যার অভিযোগ আনেন।
পৃথিবীতে কোনো শাসকই বিতর্কের উর্ধ্বে ছিলেন না। তাই শমসের গাজী শতভাগ নিষ্কলুষ ছিলেন, তা দাবি করা বাহুল্য মাত্র। শমসের গাজীও হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চতুরতা, শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, প্রয়োজনে পাশ্ববর্তী জমিদারদের সম্পদে হানা দিয়েছেন। তবে শমসের গাজীকে যে বিষয়গুলোতে অভিযোগ করা হয় তা যদি সমকালীন ইতিহাসের মানদণ্ডে বিচার করা হয়, তবে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিতে হয়। কারণ রাজনীতি ও রণকৌশলে নৈতিকতার চর্চা সমকালীন শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে বিরল।

শমসের গাজীর কৃতিত্ব

শমশের গাজী সামান্য সময় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু সে সময়টাই ইতিহাসে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। শমসের গাজী রণকৌশলের দিক থেকে, সাহসের দিক থেকে কিংবা সুশাসনের দিক থেকে পর্যালোচনা করলে তাকে একজন মহৎ শাসক ছাড়া অন্য কোনো অভিধা বেমানান। এমনকি শমসের গাজীর কট্টর সমালোচক 'রাজমালা'র লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহও গাজীর অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রজাদরদী চরিত্রের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি কৃষক-প্রজার সম্মিলিত শক্তির সহায়তায় রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণ করে কৃষক-শ্রমিকদের ভুলে যাননি। তার শাসনামলে প্রজাদের ভালো-মন্দের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন সর্বাধিক। তখনকার সময়ে কৃষকদের খাজনা মওকুফ করে দিয়ে সামন্ত রাজার বিপক্ষে লড়ার হিম্মত আর কোনো শাসক, জমিদার, নবাবরা দেখাতে পেরেছিলেন কি? এখানেই শমসের গাজী অন্যদের থেকে আলাদা।
মাত্র এক দশক সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে তিনি যে প্রজাহিতকর কাজ সম্পন্ন করেছেন, তার উদাহরণ সমসাময়িক ইতিহাসে জুড়ি মেলা ভার। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি ফেনী নদীতে বাঁধ নির্মান করেছিলেন, যা আদতেই একটি ঐতিহাসিক চিন্তা। ফেনী নদীর দক্ষিণ শিক (বর্তমান ছাগলনাইয়া) ও নিজামপুরে ফেনী নদীর দুটি অস্বাভাবিক বাঁক ছিল, যার জন্য প্রত্যেক বছর বন্যা হত। শমসের গাজী খাল কেটে বাঁকা নদীকে সোজা করেন, যা আজও কাটা গঙ্গা ও মরা গঙ্গা নামে পরিচিত।
প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে ছাগলনাইয়ায় তার মায়ের নামে খনন করা কৈয়ারা দীঘি আজো কালের স্বাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। তাছাড়া একখুইল্লা দীঘি, বুড়া সামন্তের দীঘি, তার মেয়ের নামে তনু বিবির দীঘি, বল্লভপুরের আলীয়া গাজীর দীঘি, পূর্ব ছাগলনাইয়ার দেয়ান আব্দুর রাজ্জাকের দীঘি সহ অসংখ্য দীঘি খনন করেছিলেন।

হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দরিদ্র ধর্মপ্রচারকদের তিনি অর্থ, নিষ্কর জমি প্রদান করেছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট, মসজিদ-মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও জগন্নাথ মন্দির আজও তার স্মৃতি বহন করে চলছে।
জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে বিভিন্ন জায়গায় তিনি অসংখ্য সড়ক নির্মান করেছিলেন, যা এখনো ত্রিপুরা ও নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলে গাজীর আইল নামে পরিচিত। নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তিনি নির্মাণ করেছিলেন দুর্গ ও সেনানিবাস।
পণ্যদ্রব্যের ওজন ও মূল্য নির্ধারণের মতো জনহিতকর সিন্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বিনামূল্যে ছাত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার মতো উদ্যোগ সেই সময়টাতে শমসের গাজী নিয়েছিলেন, যখন জমিদার কিংবা ভূস্বামীরা কৃষকদের উপর কীভাবে খাজনা আরো বাড়ানো যায়, সে চিন্তায় মশগুল ছিলেন।
দক্ষিণ শিক (ছাগলনাইয়া), আরামরাবাদ-ফেনী, খণ্ডল, জগৎপুর, সীতাকুন্ড-চট্টগ্রাম, তিষ্ণা-চৌদ্দগ্রাম, খাঞ্জানগর, বাগাসাইর, পার্টিকরা, নূরনগর, গঙ্গামণ্ডল, সরাইল-কুমিল্লা, বিসালগড়-সিলেট,  কুমিল্লা , জাহাননগর, মেহেরকুল,  বলদাখাল, কসবা, অষ্টজঙ্গল, চাকলা-রৌশনাবাদ, ভুলুয়া (নোয়াখালী) নিজামপুর পরগণা সহ বিশাল অঞ্চল অল্প সময়ে তার শাসনাধীন হয়েছিল।
তার শাসনাধীন অঞ্চলে তিনি যে সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তা একজন শমসের গাজীকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাই তো 'গাজীনামা'য় শেখ মনোহরের পুঁথির লাইনের মতো বলতে হয়-
“এখানে আসিয়া কবি শেখ মনোহর ভনে
শমসের গাজী ভাটির বাঘ জানুক জনে।”

তথ্যসূত্র: 

১. শমশের গাজী- আহমদ মমতাজ, প্রকাশক- বাংলা একাডেমি (২০১৩)
২. গাজীনামা- মনোহর শেখ
৩. রাজমালা- ভূপেন্দ্রচন্দ্র  চক্রবর্তী
৪. রাজমালা- কৈলাসচন্দ্র সিংহ
৫. The Land of Fourteen Gods: Ethno-cultural Profile of Tripura- Banikantha Bhattacharyya


বঙ্গবীর শমসের গাজীসমশের গাজী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক।[১] ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন তিনি ভাটির বাঘ বলে পরিচিত। শমসের গাজী নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন।

জন্ম

বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা। আঠার শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় এক বিপ্লবীর অভ্যুদয় ঘটে। তাঁর নাম শমসের গাজী। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ তাঁর উপাধি। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে দিলেন জ্ঞানপ্রদীপ। জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে অসফল প্রেম তাঁর জীবনকে উন্নীত করে ভিন্ন মাত্রায়। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। [২]
বঙ্গবীর শমসের গাজী বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল পীর মুহাম্মদ মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান এবং মাতার নাম ছিল কৈয়্যারা বিবি। [৩] তিনি প্রথম জীবনে এক জমিদারের ক্রীতদাস ছিলেন।[১]

শৈশব

ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড ধরে ৭ কিলোমিটার চট্টগ্রামের দিকে গেলেই সামনে পড়ে কৈয়ারা বাজার। এখানে গ্রামটির নামও কৈয়ারা। এই কৈয়ারা গ্রামটি কৈয়ারা বিবির নামানুসারে রাখা হয়েছে। আর কৈয়ারা বিবি হচ্ছেন শমসের গাজীর মা। শমসের গাজীকে বলা হয় ভাটির বাঘ। তার বাবার নাম পীর মোহাম্মদ। পীর মোহাম্মদ একজন খাজনা আদায়কারী ছিলেন। কোনো এক কারণে তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বেদরাবাদ এলাকায় চলে আসেন। আর্থিক কষ্টে তিনি যখন দিশেহারা তখন নিজকুঞ্জরা মৌজার দানশীল ব্যক্তি নাসির মন চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন। সেই বাড়িতেই শমসের গাজী ভূমিষ্ট হন। শমসের গাজীর বাল্যকাল ছিল বৈচিত্র্যময়। অতি অল্প বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। অভাবের সংসার সত্ত্বেও বালক শমসের ছিলেন খুবই দুরন্ত স্বভাবের। একদিন মায়ের বকুনি খেয়ে তিনি ফেনী নদীর তীরে বসে কাঁদছিলেন। তখন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন শমসেরকে দেখতে পান। দয়াপরবশ হয়ে তিনি শমসেরকে শুভপুর নিয়ে যান। শুভপুরের তালুকদারের কোনো সন্তান ছিল না। সেখানে স্নেহ-মমতার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের গাজী। লেখাপড়ার পাশাপাশি কুস্তি, লাঠিখেলা, তীর-ধনুক চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে তালিম নিতে থাকেন।

জমিদারি লাভ

তালুকদার জগন্নাথ সেনের মৃত্যুর পর যুবক শমসের গাজী শুভপুরের খাজনা আদায় শুরু করেন। শুরু হয় তার উত্থান। সে সময় তিনি চোর ডাকাত ও জলদস্যুদের রুখতে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। গাজীর এই বাহিনীর সেনাপতি ছিল তার জ্ঞাতি ভাই ছাদু পালোয়ান। ১৭৩৯ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজের সেনাপতি শমসের গাজীর এলাকায় প্রবেশ করলে সেনাপতি ছাদু পালোয়ানের প্রতিরোধে তারা ধরাশায়ী এবং বন্দি হন। ত্রিপুরার মহারাজ তার সেনাপতির মুক্তির শর্তে গাজী কেদক্ষিণশিকের বৈধ জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। শমসের গাজী ছিলেন প্রজাদরদি। পাহাড়িয়া ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে তিনি কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন এবং পরবর্তী তিন বছর মহারাজের রাজকোষে খাজনা দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। এতে ত্রিপুরা মহারাজ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ৭ হাজার সৈন্য পাঠায় গাজীকে উচ্ছেদ করার জন্য। ফল হয় বিপরীত। শোচনীয় পরাজয়ে প্রাসাদ ছেড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের বিরাট অংশ শমসের গাজীর করতলে এসে যায়। শমসের গাজীর রাজত্বকালে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরেই ছিল। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে ফেনী নদীবেষ্টিত জগন্নাথ-সোনাপুরস্থ চম্পকনগরে তার প্রধান কেল্লা ও রাজপ্রাসাদে থাকতেন।

স্মৃতি ও কীর্তির নিদর্শন

কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকান্ডের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুররাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। ভুখানাঙা চাষাভুষাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে। হীরকডানায় ভর করে যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ান তেজোদীপ্ত যবন বীর শমসের। শত্রুসেনা বিনাশ করতে করতে হয়ে ওঠেন অবিনাশী যোদ্ধা, অপ্রতিরোধ্য হন্তারক। অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন টানা এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা।
ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে ভারতের সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজীর দীঘি এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে রয়ে গেছে।[৪]

নির্মমভাবে হত্যা

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। বাংলার এমন দুর্যোগ মুহূর্তে স্থানীয় কুচক্রী মহল, ঢাকার নবাবের প্রতিনিধি, ইংরেজ বেনিয়া ও পরাজিত, বিতাড়িত ত্রিপুরার মহারাজ একত্রিত হয় শমসের গাজীর বিরুদ্ধে। শমসের গাজীর দেশপ্রেম ও সাহসিকতা ইংরেজ এবং এ দেশীয় দালাল কুচক্রীদের ভীত করে তুলেছিল। নবাবের নামে মূলত ইংরেজরাই ষড়যন্ত্র করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী এবং যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের নেতৃত্বে পাহাড়ী উপজাতীয় যৌথবাহিনী শমসের গাজীর কেল্লা ও উদয়পুরে আক্রমণ চালিয়ে গাজীকে পরাজিত ও আটক করে। তাদের এতটাই আক্রোশ ছিল যে, ত্রিপুরার মহারাজ হাতিসহ হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে চম্পকনগরস্থ শমসের গাজীর প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।
শুরু হয় আরেক লড়াই। চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। একদিকে তিনি অকুতোভয় বীর, প্রজাদরদি রাজা, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে মনকাড়া বাঁশিওয়ালা। গভীর রাতে বাঁশির সুর শুনে বেরিয়ে আসেন আত্মগোপন থেকে। অমীমাংসিত থেকে যায় তাঁর মৃত্যু।


শমসের গাজীর কেল্লা ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার চম্পকনগর ও জগন্নাথ সোনাপুরএ অবস্থিত।[১] বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। শমসের গাজী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক।[২] ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন তিনি ভাটির বাঘ বলে পরিচিত। শমসের গাজী নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন।

অবস্থান

ফেনীর ছাগলনাইয়ার চম্পকনগর ও জগন্নাথ সোনাপুরের বর্তমান ভারত সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজীর দীঘি এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে রয়ে গেছে।

বর্তমান অবস্থায়

শমসের গাজীর তৈরি দুর্গটি এখন বিলুপ্ত। কিন্তু সেখানে তার স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছুই রয়ে গেছে। তার তৈরি কৈয়্যারা দিঘী,গুপ্ত সুড়ঙ্গ ইত্যাদি রয়ে গেছে। কিছু কিছু স্থাপত্য এখন পাশে ভারতের সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরা রাজ্যে রয়ে গেছে। বর্মানে তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে সেখানে শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্টস নামক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। অনেক পর্যটকই সেখানে ভ্রমন করেন।

শমসের গাজী  আঠারো শতকের ৪০ এর দশকের প্রথম দিকে ‘ভাটির বাঘ’ নামে খ্যাত। তিনি নোয়াখালীর এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দক্ষিণ কুমিল্লা ও উত্তর নোয়াখালী জুড়ে বিস্তৃত চাকলা রওশনাবাদের অধিপতি হয়েছিলেন। ক্রমে তিনি সমগ্র কুমিল্লা জেলাই দখল করেন। তিনি নিজামপুর পরগনা জয় করে মেঘনা, মুহরী ও মনুগঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চলের মুকুটহীন রাজা হন। তিনি শৈশব থেকে সাহসী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তখন চাকলা রওশনাবাদ ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন। জমিদার ছিলেন নাসির মাহমুদ। জমিদার যত্ন করে শমসেরকে লালন-পালন করেন। যুবক শমসের অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে জমিদার-তালুকদারের জোর-জুলুম ও লুণ্ঠনে প্রজাগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শমসের গাজী সমগ্র অঞ্চল দখল করে শাসন শুরু করেন। দরিদ্র কৃষকের কর তিনি মওকুফ করেন। তাঁর অর্থনৈতিক সুব্যবস্থার জন্য জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়। তিনি বহু হিন্দু-মুসলমানকে লাখেরাজ ভূমি দিয়েছিলেন। তিনি রাজধানী জগন্নাথ সোনাপুর ও রাজধানীর বাইরে বহু দিঘি খনন ও বিদ্যালয় নির্মাণ করেছিলেন। দিঘিগুলির মধ্যে ‘কৈয়ার সাগর’ ছিল বৃহত্তম।
ত্রিপুরাধিপতি কৃষ্ণমাণিক্য তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ কুকী বাহিনীর দুটি শক্তিশালী অভিযান পাঠিয়েছিলেন। শমসের গাজীর অসাধারণ সমর-কৌশল ও শৌর্যবীর্যের দরুন দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। গাজী ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর দখল করেন। রাজা আগরতলায় পলায়ন করেন এবং বাংলার নওয়াব মীরকাসিমের শরণাপন্ন হন। নওয়াবের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলে যড়যন্ত্র করে শমসের গাজীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয় (১৭৬০)। কৃষ্ণমাণিক্য তাঁর হূতরাজ্য পুনর্দখল করেন


ফেনী জেলার ছাগলনইয়া একসময়ের ভাটির বীর শমসের গাজীর বাগান বাড়ির অবস্থান। একসময় এ অঞ্চলের একমাত্র পরাক্রমশালী শাসক ও স্থানীয় পরাশক্তি যোদ্ধাশাসক  শমসের গাজির বাড়ি। মূলত এ বাগান বাড়িতেই একসময় তার প্রাসাদ। । ৩৫০ বছর পূর্বের একজন শাসক কীভাবে তার সেনা দূর্গ ও রাজধানী প্রতিরক্ষার জন্য  আধুনিক রণকৌশল ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তার বহু নির্দর্শন মিলবে এখানে। সৌখিন বংশীবাদক শমেসের গাজী সমসাময়িক কালে বাংলার একমাত্র শাসক যিনি
ত্রিপুরা অধিকার করেছিলেন এবং ফেনীর চম্পক নগর থেকে পুরো রাজ্য পরিচালনা  করেছেন। তিনি রাজধানীতে না থেকে তার জন্ম ভিটায় থাকতে বেশী পছন্দ করতেন।  এখানে তার একটি কেল্লাও ছিলো।
বীর ‬শমসের গাজী তার মাতার নামে এ দীঘি খনন করলেও এটা এখন শমসের গাজীর দিঘী হিসেবে পরিচিত। এ দীঘি ছাগলনাইয়া উপজেলা সদরের নিকটবর্তী ভারতীয় সীমান্তের কাছে সোনাপুর গ্রামে অবস্থিত। ৪.৩৬ একর আয়তনের এ দীঘি ১/৩ভাগ ভারতীয় অংশে পড়েছে।
এই দিঘীর পাড়ে রয়েছে শমেসের গাজীর সুড়ঙ্গ। এটি একসময় বন্ধ করে দেয়া হলেও। এর স্মৃতিচিহ্ন এখনো রয়েছে। কথিত আছে এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে রানীরা দিঘীতে গোসল করতে যেতেন। এছাড়া এই সুড়ঙ্গ নিয়ে নানারকম ও লোককথা রয়েছে। ব্রিটিশদের সহায়তায় ত্রিপুরার রাজা যখন শমসের গাজীর বসভিটা আক্রমণ করেন এবং তা গুড়িয়ে দেন। তখন তিনি এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করে থাকেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ গাজী ছিলেন একজন শিল্পরসিক ও প্রেমিক পুরুষ। তিনি বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন এবং বাঁশির সুর ভালোবাসতেন। ত্রিপুরা রাজা তাকে হত্যা করার জন্য গভীর রাতে একজন বংশীবাদক দিয়ে বাঁশির সূর তোলেন। পরে গোপনীয় স্থান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। এবং তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। একজন বীর যোদ্ধার জীবনাবসান এবং এই অঞ্ছলে ব্রিটিশ আধিপত্য একসাথে প্রতিষ্ঠিত হয়।

 ফেনীর ছাগলনাইয়া পরশুরাম এলাকাটি একটি উপত্যকার মত। এক সময় এ এলাকাকে বলা হত চাকলালা রৌশনাবাদ। এ চাকলালা রৌশনাবাদের পুর্ব পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা চোট বড় পাহাড় আর দক্ষিনে সাগর। মাজখানে চমৎকার সমভুমি। এর বুক চিরে বইচে মুহুরী, কহুয়া ও চিলুনিয়া নদী। বর্ষা কালে অতি বৃষ্টি হলে ত্রিপুরার পাহাড়ী ঢল নদীর দু’কুল ভেষে নিকটবর্তি নিচু জমি ও বাড়ী ঘর ভাষিয়ে গেলেও এর স্থায়ীত্ব থাকে ক্ষনস্থায়ী। বৃষ্টি থেমে গেলে পানী নেমে যায় বাকি সময় একেবারেই শান্ত। বিস্তির্ন ফষলী মাঠ নদীর কল কল ধ্বনী। পাখির কলতান।এ উপত্যকার জমিদার ছিলেন জমিদার নাছির মোহাম্মদ। আর জমিদারের তহসিলদার ছিলেন শমশের গাজী, সুদর্শন সুঠাম দেহী শমশের সহজেই জমিদার পরীবারের মন জয় করে নেন। এ সুবাদে তার অবাধ যাতায়াত ছিল জমিদার মহলে। প্রেমে পড়ে যান জমিদারের একমাত্র সুন্দরী কন্যা দৈয়া বিবির সাথে।
জমিদার কন্যার সাথে সামান্য তহসিলদারের প্রেম! অসম্ভব। রেগে অগ্নিশর্মা নাছির মোহাম্মদ। যেভাবেই হোক শমশেরের মস্তক চাই। শমশের এরুপ পরিস্থিতির জন্য আগেই প্রস্তুত ছিল। বেধেগেল যুদ্ধ। শমশেরের বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গোপনে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। সাহসী এবং ভীর শমশেরের নেত্রিত্বে লাঠিয়াল বাহিনী উল্কা বেগে আক্রমন করে বসল জমিদার বাড়ী। কার সাধ্য তাকে রোখে!। নাছির মোহাম্মদের সোচনীয় পরাজয়। কোন রকমে প্রান নিয়ে পালিয়ে গেলেন উদয়পুরে। সে থেকে ফেনীর লোক কাউকে ধমকাতে গিয়ে বলে (এক্কারে দোম্বই উধপুর নিমুগোই) একেবারে দোড়াই উদয়পুর নিয়ে যাব।
পালিয়ে যাওয়ার সময় নাছির মোহাম্মদ তার কন্যাকে সাথে নিতে চেয়ে ছিলেল কিন্তু দৈয়া বিবি আগেই শমশেরের শিবিরে চলে আসেন। কাজে মেয়েকে ফেলেই নাছির মোহাম্মদকে পালাতে হয়েছিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে। আশ্রয় নিয়ে ছিলেন উদয়পুরের জমিদার বাড়ীতে। শমশের দৈয়া বিবিকে পেলেন সাথে জমিদারিও। শমশেরের জমিদারী আমল ছিল ব্যতিক্রম ধর্মী। সাহসী বীর শমশের ভয় পেতেন না কাওকে বরং লোকে তাকে ভয় পেত। আশ পাশের অন্যান্য জমিদার গন, সুদ খোর মহাজন, মুনাফা খোর এবং জোরদারদের কাছে সে ছিল মুর্তমান আতংক। তাদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে সাধারনের মধ্যে বিলি করতেন অথবা জনসার্থে ব্যয় করতেন অকাতরে তাই জোরদারদের কাছে সে ছিল শমশের ডাকু আর স্বাধারনের কাছে গাজী। তার ভয়ে এবং আতংকে আশ পাশের জমিদারদের ঘুম হারাম হয়ে যায় শমশের কখন কার জমিদারী দখল করে নেয়। ভয়ের আরেকটি কারন হচ্ছে শমশেরের জনপ্রিয়তা।
নাছির মোহাম্মদ ও অন্যান্য কতিপয় জমিদার নবাবের দরবারে হাজির মুর্শিদাবাদে। জমিদারগন নবাবকে বুজাতে সক্ষম হন যে; শমশেরের গতি এখনি রোধ করা না গেলে সে আশেপাশের অন্যান্য জমিদারী দখল করে নিবে এবং নিজেকে স্বাধীন ঘোষনা করবে।
নবাব সৈন্য পাঠালেন, কৌশলে শমশের গাজীকে বন্ধিকরা হল এবং নির্মমভাবে হত্যা হল। তার ভুগভর্স্থ অশ্রাগার ধ্বংশ করা হল যা “শমশের গাজির এক্ষুল্যা” নামে ইতিহাসে সাক্ষি হয়ে আছে।
শমশের বেশ কিচু জনহিতকর কাজ করে গেছেন। সুপেয় পানির জন্য ফেনীর যায়গা যায়গায় বড় বড় দীঘী ক্ষনন করেছেন, চলাচলের জন্য রাস্তা, কেনা কাটার জন্য হাট বাজার।
শমশের গাজী দীঘি, কৈয়ারা দীঘি, দৈয়া বিবির রাস্তা, দৈয়া বিবির হাট তাকে অমর করে রেখেগেছ্। আজো নিশীথ রাতে হুহু হুহু করে বাতাস কাদে; গ্রামে আজ ও বিলাপ হয় “ঢাকা গিয়া শমশের গাজী কিনি খাইলো নুন, কৈয়ো কৈয়ো মায়ের কাছে গাজী হইলো খুন”।


 উপরন্তু খুব দ্রুত সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে তার বহি:শত্রুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি
পাচ্ছিল। সমসাময়িক অন্য জমিদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরির কোন উদ্যোগ তিনি গ্রহণ
করেননি। ফলে তিনি মিত্রহীন হয়ে পড়েন। এরই মাঝে তিনি নিজামপুর পরগণার জমিদার
আগা বাকের এর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। নবাব আলীবর্দী খাঁর রাজপরিবারেও তখন
নানা রকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল কারণ তাঁর বড় কন্যার জামাতা ছিলেন ঢাকার নায়েবে
নাজিম হোসাইন উদ্দিন খাঁ। তিনি ঢাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু কোন এসব অজ্ঞাত
কারণে হোসাইন উদ্দিন খাঁর প্রতি নবাব আলী বর্দী খাঁর নাতি সিরাজ উদ দৌলা অসন্তুষ্ট
ছিলেন। অন্যদিকে আগা সাদেক ছিলেন সিরাজের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং প্রিয়ভাজন। এমনিতর
একটি প্রেক্ষাপটে মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবার থেকে আমন্ত্রণ আসলে শমশের গাজী
সেখানে যেতে মনস্থির করলেন। তদুদ্দেশ্যে তিনি সোনাপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা
হন। মনোহর শেখের বক্তব্য অনুযায়ী তিনি জামাতা হোসাইন উদ্দিন খাঁর বাসস্থান হোসেনি
দালানে ৭দিন অবস্থান করেন। জামাতার নিষেধ সত্বেও তিনি মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে
রওনা হন। নবাবের সাথে সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পথে আগা সাদেকের বাহিনী কর্তৃক বন্দি
হন। বন্দি অবস্থাতেই বীর কেশরী শমশের গাজীকে হত্যা করা হয়। যবনিকাপাত ঘটল একটি
অধ্যায়ের। শমশের গাজীকে নিয়ে যে পরিমাণ বির্তক হয়েছে বা তার কর্মকা-ের মাঝে যে
পরিমাণ বৈপরিত্য রয়েছে তা সমসাময়িক সময়ে বাংলার আর কোন ব্যক্তিকে নিয়ে হয়নি।
তাকে কখনো মনে হয়েছে স¤্রাট আত্তরঙ্গজেবের মত ন্যায় পরায়ণ শাসক, আবার কখনও মনে
হয়েছে শেরউড জঙ্গলের রবিন হুডের মত ডাকাত, কখনও মনে হয়েছে চাণক্য বুদ্ধি সম্পন্ন
ব্যক্তি আবার কখনও মনে হয়েছে অবোধ শিশুর মত সহজ সরল। কখনও মনে হয়েছে চরম
উচ্চাভিলাষী আবার কখনও মনে হয়েছে পরিস্থিতির নায়ক, কখনও মনে হয়েছে অর্থ লিপ্সু,
আবার কখনও মনে হয়েছে প্রজাবৎসল মহান শাসক। শমশের গাজীকে নিয়ে সত্যিকার অর্থে
বৃহৎ আঙ্গিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে কোন প্রকার গবেষণা আজ অবধি হয়নি। বিছিন্নভাবে ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র কিছু কাজ হয়তো হয়েছে, যা একজন শমশের গাজীকে উপলব্ধি করার জন্য মোটেও
পর্যাপ্ত নয়। শমশের গাজীর জীবনের প্রতি পরতে পরতে রহস্য আর বিভ্রান্তি। তিনি স্বীয়
আশ্রয়দাতা নাছির মোহাম্মদের কন্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান, প্রস্তাব প্রত্যাখাত
হবার পর তার চাচাত ভাই এবং সহযোগী ছাদু পালোয়ান নাছির মোহাম্মদকে হত্যা করেন।
শমশের গাজীর জীবনীকার মনোহর শেখের মতে এতে শমশের বিক্ষুদ্ধ হন এবং ছাদু
পালোয়ানকে তিরস্কার করেন। আবার কিছুদিন পরেই ছাদু পালোয়ানকে সাথে নিয়ে নাছির
মোহাম্মদের সৈনিকদের সাথে যুদ্ধ করেন এবং নাছির মোহাম্মদের দুই পুত্রকে হত্যা করেন।
তাহলে মনোহর শেখের বর্ণনামতে ছাদুপালোয়ানের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হবার কথাটি ধোপে টিকে
না। শুধু তাই নয় পানুয়াঘাট দুর্গের প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ডাকাতদের সাথে
বন্ধুত্ব করেন। ডাকাতির সামগ্রীর অর্ধেক উপঢৌকন হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রভূত
সম্পদের মালিক হন। অভিযোগ আছে পরবর্তী জীবনেও শমশের গাজী ডাকাতির এই অভ্যাস
ত্যাগ করতে পারেননি। নিজ রাজ্যের বাইরে ধনী ব্যাক্তি কিংবা অন্য জমিদারদের অর্থ
সম্পদ লুট করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মৌলভি হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর রচিত
তাওয়ারিখ ই-হামিদ গ্রন্থে এবং মি. কামিন্স এর প্রতিবেদনে গাজীকে বড় লুন্ঠনকারী
(এৎবধঃ চষঁহফবৎবৎ) আখ্যা দেয়া হয়েছে। “রাজমালা” গ্রন্থে তাকে বারবার শমসের
ডাকাত হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। যে ছাদু পালোয়ান শিশুকাল থেকে শমশের গাজীর
সাথে ছায়ার মত মিশে ছিলেন, গাজীর প্রতিটি সাফল্যে যার অবদান অসামান্য সেই ছাদু
পালোয়ানকেও ক্ষমতার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে হত্যা করেন শমশের গাজী। নিজের
প্রয়োজনে অসংখ্যবার তিনি পার্শ¦বর্তী জমিদারদের পুকুরের মাছ লুন্ঠন করেন। এ সমস্ত
আচরণের কোনটাই একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ব্যাক্তির সাথে যায়না। আবার অসংখ্য জনহিতকর
কর্মকা- তাঁর দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। পানীয় জলের
সমস্যা সে আমলে জনসাধারনের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল। এ সমস্যা সমাধানে শমশের
গাজী অনেকগুলো দিঘি খনন করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৈয়ারা দিঘি, বুড়ো সা¤œী
দিঘি, নর্দমা দিঘি, রাঙ্গামাটি দিঘি, একখুইল্লার দিঘি, সাত কুচিয়া শমসের গাজীর
দিঘি, তনু বিবির দিঘি, মনু বিবির দিঘি, কাটা গাং, মরা গাং, ফটিকছড়ির শমশের
গাজী দিঘি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে কৈয়ারা দিঘি এবং সাত কুচিয়া শমসের গাজীর
দিঘি আয়তনের দিক থেকে কুমিল্লার ধর্মসাগরের চাইতেও বিশাল আবার একখুইল্লার দিঘিটি
বিস্ময়কর, এর চর্তুদিকে পাহাড় মাঝখানে অত্যন্ত গভীর । ১৯৪৭ সনে দেশভাগের সময় এই
জলাশয়ের অধিকাংশ অংশ ভারতের অন্তর্গত হয় আর কিছু অংশ বাংলাদেশের অংশে। ১৯৭১ এ
মহান মুক্তিযদ্ধের সময় ভারতে আশ্রিত শরণার্থীরা এ দিঘির পানি ব্যবহার করত। ত্রিপুরা
জয়ের পর রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে চন্দ্রপুর গ্রামে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যদিও
তা অযতœ-অবহেলার কারণে এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। অসম্প্রদায়িক শমশের গাজী
মসজিদের পাশাপাশি মেহেরকুলের (কুমিল্লা) একাধিক স্থানে কালিমন্দির নির্মাণ করেন।
কৈয়ারা দিঘি এবং বাজারের পাশে শমশের গাজী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঈদগাঁএ মুসলমানরা
এখনও দুই ঈদের নামাজ আদায় করে। চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রণেতা ওহীদুল আলমের মতে
চট্টগ্রামের উত্তর সীমানায় ফটিকছড়ি উপজেলায় চাড়ালিয়া হাটের নিকট শমশের গাজীর
দিঘি ও টিলা রয়েছে। তিনি জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার
প্রভূত উন্নয়ন করেন। জগন্নাথ সোনাপুর কেল্লাবাড়ী থেকে সোজা পশ্চিম দিকের সড়কটি
শমশের গাজী রোড নামে পরিচিত। সড়কটি ঢাকা চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়ক সংলগ্ন। শমশের
গাজী ত্রিপুরা রাজ্য জয় করে জনসাধারণের সুবিধার্থে সেখানে অনেকগুলো সড়ক নির্মাণ
করেন। সেগুলি গাজীর আইল নামে পরিচিত। কুমিল্লাতেও রয়েছে শমশের গাজীর স্মৃতি।
কুমিল্লা শহর থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে বিবির বাজার সংলগ্ন গোলাবাড়ী গ্রামে শমশের
গাজী একটি কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। কেল্লার ধ্বংসাবশেষ কিছুকাল আগেও বিদ্যমান
ছিল। গোলাবাড়ী থেকে যে সড়কটি উদয়পুরের দিকে গেছে তা স্থানীয়দের নিকট গাজীর
আইল নামে খ্যাত। কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের রাঙ্গামাটি গ্রামে তিনি আরেকটি কেল্লা
নির্মাণ করেছিলেন। চাকলা রোশনাবাদ এবং মেহেরকুল পরগণার বিভিন্ন স্থানের সুরক্ষার
জন্য তিনি আরো অনেকগুলো কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। কৈয়ারা দিঘি এবং বাজার সংলগ্ন
স্থানে শমশের গাজী স্থাপন করেন একটি সেনানিবাস। এই সেনানিবাসে দুই হাজার সৈন্য
অবস্থান করত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া গোমতি নদীর তীরে শমশের গাজী একটি
বিশাল দুর্গ নির্মাণ করেন এটি গাজীর কোট নামে পরিচিত। নিজামপুর পরগণায়ও
(বর্তমানে মীরেরসরাই) তিনি একটি কেল্লা তৈরি করেছিলেন। শমশের গাজী রাজ্য
বিস্তার এবং যুদ্ধবিগ্রহ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন একথা ভাবলে শমশের গাজীর প্রতি অন্যায়
করা হবে। তিনি শিক্ষা বিস্তার এবং ন্যায় পরায়ণতা এবং জনসাধারণকে ন্যায্য মূল্যে
দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজেও মনোনিবেশ করেন। ছাত্রদের শিক্ষাদানের
উদ্দেশ্যে শমশের গাজী নিজ অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বিদ্যালয়। যেখানে ১০০
ছাত্রের অধ্যয়ন, তাদের থাকা-খাওয়া, বস্ত্রসহ যাবতীয় সুব্যবস্থা ছিল। এটি ছিল একটি
আবাসিক বিদ্যালয়। যেখানে আরবি, ফারসি ভাষার সাথে মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদান
করা হতো। প্রজাদের মঙ্গল সাধনই ছিল তাঁর শাসনের বৈশিষ্ট্য। তার পূর্বে রাজ্যে পণ্যের
ওজনের কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি বিদ্যমান ছিলনা। তিনিই পণ্যের ওজনের একক চালু করেন।
কোন দ্রব্য কত মূল্যে বিক্রয় হবে তার একটি তালিকা প্রত্যেকটি বাজারে টানিয়ে দেয়া
হয়েছিল। তিনি অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা ধারণ করতেন এবং স্বস্ব যোগ্যতা অনুযায়ী
নিয়োগ দিতেন গুরুত্বপূর্ণ বহুপদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগদেন শমশের গাজী। গঙ্গা
গোবিন্দ, হরিহর দেওয়ান, শ্রী চাঁদ ঠাকুর, রামধন বিশ্বাস, মনু সরকার ও তার পুত্র
কনুরাম, দু:খীরাম মন্ডল প্রমুখের নাম পাওয়া যায় গাজী নামায়। তিনি স্বয়ং একজন হিন্দু
ধর্মাবলম্বী নারীকে বিয়ের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেন।
ত্রিপুরার ইতিহাসে তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রশংসা করা হয়েছে। শমশের গাজীর
কঠোর সমালোচক কৈলাশচন্দ্র সিংহ লিখেছেন, “ধর্মপুর নিবাসী গঙ্গাগোবিন্দ প্রধান
দেওয়ান এবং খন্ডল নিবাসী হরিহর দেওয়ান পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন”। তিনি হিন্দু
মুসলমান নির্বিশেষে মুসলিম ধর্মপ্রচারক আর দরিদ্র ব্রাহ্মণদের নি:ষ্কর ভূমি দান
করেছিলেন। কৈলাশচন্দ্র সিংহ মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্যর প্রশংসা করতে যেয়ে তাঁর ভাষায়
“ডাকাইত শমশের গাজী কর্তৃক প্রদত্ত বহু নি:ষ্কর মিনা আর দেবোত্তর সম্পত্তি ফিরিয়ে
দেয়ার কথা বলেছেন”। এমনকি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক কদম মোবারক মসজিদ এবং ঢাকার
ঐতিহ্যবাহী হোসনী দালানের সাথেও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে শমশের গাজীর নাম।
যদিও হোসেনী দালানের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত নয়। শমশের গাজীর মৃত্যু
ইতিহাসের আরেক অজানা অধ্যায়। তার মুত্যুর সময় এবং স্থান নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্ক
রয়েছে তা সমসাময়িক ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তার মৃত্যু সম্পর্কে
প্রচলিত বক্তব্য গুলি নি¤œরূপ। ১) শমশের গাজীর বিচিত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭৬০
সনে ( ত্রিপুরার রাজমালা-পুরঞ্জন প্রসাদ চক্রবর্তী)
২) নওয়াবের সাথে সাক্ষাতের কথা বলে ষড়যন্ত্র করে শমশের গাজীকে ধরে নিয়ে হত্যা
করা হয় ১৭৬০ সনে ( আলী নওয়াজ বাংলা পিডিয়া)
৩) মীর কাশিম বাংলার নবাব থাকাকালে সৈন্য পাঠিয়ে শমশের গাজীকে বন্দি করে নিয়ে
আসেন এবং তোপের মুখে ফেলে তাকে হত্যা করেন। (কুমিল্লা জেলার ইতিহাস- আবুল কালাম
মো. যাকারিয়া)
৪) মুর্শিদাবাদে আসাদুল্লাহ (নবাব সরফরাজ খাঁর উপাধি) নামক নবাবের নির্দেশে আগা
বাকের সৈন্যবাহিনী নিয়ে রোশনাবাদে উপস্থিত হন। মোবারকের ঘোনা নামক স্থানে তুমুল
যুদ্ধে শমশের পরাজিত হন। আগা বাকের শমশের কে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান
এবং তথায় কামানের সম্মুখে রাখিয়া উড়াইয়া দেয়া হয়। (আগা বাকের ও আগা সাদেক-
মৌলভি মোহাম্মদ মহতসম বিল্লাহ চৌধুরী - নবনূর- ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা)
৫) আগা বাকের এবং জসারত খাঁর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে শমশের গাজী মুর্শিদাবাদ হইতে রংপুরের
ঘোড়াঘাটে নীত হন এবং সেখানেই চরম দৈহিক নির্যাতনের মুখে ১৭৬১ সনে তাহার প্রাণ
সংহার হয়েছিল। (তিনহাজার বছরের নোয়াখালী- কাজী মোজাম্মেল হক।)
কৈলাশ চন্দ্র সিংহের মতে যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের আবেদনের প্রেক্ষিতে নবাব মীর
কাশিমের অনুমোদন ক্রমে শমশের গাজীকে হত্যা করা হয়। পক্ষান্তরে গাজী নামার লেখক
মনোহর শেখ শমশের গাজীর জগন্নাথ সোনাপুর ত্যাগের সময়কাল উল্লেখ করেন এভাবে -
“এগারশ উনষাইট সন জৈষ্ঠ্য মাসে।
জুম্মাবারে জান তুমি জোহরের শেষে।।
উনত্রিশ তারিখ সেই ছিল শুক্রবার ।
চলিল পশ্চিম মুখে গাজি মরিবার।।”
১১৫৯ বঙ্গাব্দ কে খৃষ্টাব্দ করলে তা ১৭৫২ খৃষ্টাব্দ হয়। সমসাময়িক সময়ের ইতিহাস
পর্যালোচনা করলে মনোহর শেখের বিবরণের কাছাকাছি সময়টিকেই আমাদের গ্রহণ করতে
হয়। ত্রিপুরা রাজবংশের বিষয়ে স্মৃতি নির্ভর এবং ফরমায়েশ অনুযায়ী লিখিত রাজমালা
(দরবারী ইতিহাস) এবং ত্রিপুরার ইতিহাসে বর্ণনা অনুযায়ী নবাব শমশের গাজী ১৭৪৭-৪৮
সালে ত্রিপুরা অধিকার করেন। এ দুই গ্রন্থ মতে মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফর খান এবং
পরবর্তীতে মীর কাশিম খান কোন একজনের শাসনকালে ও নির্দেশে শমশের গাজীর মৃত্যু ঘটে
এ ক্ষেত্রে নবাব মীর কাশিমের দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়। কিন্তু এটি মেনে
নেয়া কঠিন। কারণ পলাশীর যুদ্ধের পূর্বেই শমশের গাজী নিহত হন। গাজী নামার বিবরণ
অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি ১৭৫২ সনে ঢাকার
উদ্দেশ্যে জগন্নাথ সোনাপুর ত্যাগ করেন এবং তথায় তাহার জামাতা হোসাইন উদ্দিন খাঁর
গৃহে উপস্থিত হন। হোসাইন উদ্দিন খাঁ তখন ঢাকার জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। জনতার নিকট
তিনি নবাব হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। মুর্শিদাবাদে যাত্রার কথা বললে জামাতা তাকে
নিষেধ করেন। প্রতি উত্তরে গাজীর বক্তব্য খুঁজে পাই মনোহর শেখের লেখায়-
গাজীরে বলিল বাপু অতিশ্রদ্ধা মানে।
বারে বারে ডাকে মোরে না যাই কেমনে।।
ঢাকার ইতিহাসবিদের মতে তিনিই ঢাকার ডেপুটি নায়েবে নাজিম ছিলেন। তিনি
সিরাজ-উদ-দৌলার চাচা সম্পর্কিত ছিলেন। সিরাজের ঘনিষ্ট আগা সাদেকের সাথে তাঁর
বিরোধ তৈরী হয়। আগা সাদেকের ষড়যন্ত্রে ১৭৫৪ খৃষ্টাব্দের প্রথম দিকের এক রাতে
হোসেন উদ্দিন খাঁ-কে তাঁর বাস ভবনে ঘুমন্ত অবস্থায় নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়। এ সময়
মুর্শিদাবাদে নবাব হিসাবে আসীন ছিলেন আলীবর্দী খান মহাবত জঙ্গি। ১৭৫১ থেকে ১৭৫৩
খৃষ্টাব্দ ইসলামাবাদের (চট্টগ্রাম) শাসনকর্তা ছিলেন আগা বাকের। উল্লেখ্য, আগা বাকের
তখন বৃদ্ধ থাকায় জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) অবস্থান করতেন এবং তাঁর পক্ষে পুত্র আগা সাদেক
শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন অভিযোগের কারণে তাকে চট্টগ্রামের ফৌজদারের
পক্ষ হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু নবাব দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলার সাথে ঘনিষ্ঠতার
কারণে তাঁরা বহাল তবিয়তে ঢাকা অবস্থান করতে থাকেন এবং বিভিন্ন প্রকার প্রাসাদ
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। উপরোক্ত আগা বাকেরই শমশের গাজীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা
করেন। এ প্রসঙ্গে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত “নবনূর” পত্রিকার এক প্রবন্ধে বলা হয়
“খন্ডল প্রভৃত্তি স্থানের প্রাচীন দিকের মুখে শ্রুত হওয়া যায় রৌশানাবাদ বিজিত হইলে
তথায় শমশের গাজী স্বাধীন নরপতির ন্যায় রাজত্ব করিতে থাকেন।
ত্রিপুরাপতি রৌশনাবাদের রাজস্ব স্বরূপ নবাবের রাজকোষে যে কর প্রেরণ করিতেন শমশের
তাহা বন্ধ করিয়া দেন।”
প্রাচীনরা বলিয়া থাকেন এই সময়ে মুর্শিদাবাদে আসাদুল্লাহ্ নামের একজন নবাব রাজত্ব
করিতেন। তিনি আগা বাহার (আগা বাকের) নামক এক সামন্ত কে শমশেরের শাসনার্থে
প্রেরণ করেন। আগা বাকের সসৈন্যে রৌশনাবাদ প্রদেশে উপনীত হইলে শমশের মোবারক
ঘোনা নামক স্থানে তাহার গতিরোধ করার নিমিত্তে উপস্থিত হন। এ স্থানে উভয় পক্ষের
ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শমশের পরাজিত হন ও বন্দী হন। বাকের সমস্ত রৌশনাবাদ প্রদেশে
শান্তি স্থাপন পূর্বক শমশেরকে লইয়া মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন করেন তথায় শমশেরকে
কামানের মুখে রাখিয়া উড়াইয়া দেওয়া হয়”। তাই গাজী নামায় বর্ণিত তারিখ এবং
সমসাময়িক ইতিহাসের ধরাবহিকতার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে একথা বলা যায় ১৭৫৪ সনের
মধ্যে কোন এক সময় শমশের গাজী নিহত হন।
কোন শাসকই বিতর্কের উর্দ্ধে নন, সে অর্থে শমশের গাজীও বির্তকের বাইরে থাকতে
পারেননা। শমশের গাজীকে মূল্যায়ন করতে গেলে সমসাময়িক ইতিহাসের আলোকে মূল্যায়ন
করতে হবে। সমসাময়িক ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি, যে স¤্রাট আওরঙজেব কে মোঘল
সা¤্রাজ্যের সবচাইতে ন্যায় পরায়ণ শাসক হিসেবে গণ্য করা হয় সেই আওরঙজেব
সিংহাসনের জন্য পিতা স¤্রাট শাহজাহানকে বন্দি করেন, ভ্রাতাদের নির্বিকার ভাবে
হত্যা করেন। যে বৈরাম খাঁ স¤্রাট আকবর কে অস্ত্রবিদ্যা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন স¤্রাট
আকবর তাকে স্বহস্তে হত্যা করেন। সরফরাজ খাঁর প্রধান সেনাপতি আলীবর্দি খাঁ সরফরাজ
খাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। শুধু তাই নয় দৌহিত্র সিরাজের
সিংহাসনে আসীনের পথকে মসৃন করার জন্যে কৌশলে হোসেন কুলী খাঁকে হত্যা করেন।
সিরাজের প্ররোচনায় আগা সাদেক ঢাকার ডেপুটি নায়েবে নাজীম হোসাইন উদ্দিন খাঁ কে
হত্যা করেন। হালাকু খাঁন, চেঙ্গিস খাঁন আর তৈমুর লং এর রক্তের বন্যা বইয়ে দেবার কথা
আর নাইবা বললাম। শমশের গাজীর রণকৌশল এবং শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে আমরা
দেখবো প্রতিভা, শক্তি ও সাহসে তিনি মারাঠা বীর শিবাজী, কিংবা আফগান শাসক
শেরশাহ চাইতে কোন অংশে কম না। বাংলার বার ভূঁইয়াদের শ্রেষ্ঠ ঈসা খাঁ,
প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়ের মতো জমিদারদের কর্মকা- যদি রাজনীতি হতে পারে, তবে
শমশের গাজীকে কেন আমরা মহান দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ বলবো না! শমশের গাজী তার
আভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কিছুটা চতুরতা, শঠতা কিংবা বেঈমানির আশ্রয় নিয়েছেন
হয়তো কিন্তু এর সবই ছিলো রাজনীতি এবং রণকৌশলের অংশ। গাজীকে যদি দস্যু বলা হয়,
তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতের প্রান্তে প্রান্তে যত রাজা, নবাব, সুলতানগণ
এক অন্যের রাজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন, রাজ্য স্থাপন করেছেন তাঁরাও যে দস্যু হয়ে
যান। বরং ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর তিনি অত্যাচারী শাসকে পরিণত না হয়ে, প্রজা
দরদী শাসকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি শাসন ব্যবস্থায় সাফল্যের জন্য প্রজাদের
সন্তুষ্টি বিধানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। ত্রিপুরার রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ সহ
সামন্তবাদীদের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধে তিনি শুধুমাত্র সমর শক্তি উপর নির্ভর না করে,
জনতার শক্তি এবং ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী। কৃষক প্রজাকে তার পক্ষে একত্রিত
করেছেন। তাইতো তিনি প্রলেতারিয়েতদের নায়ক, কৃষক-প্রজার প্রাণের নেতা। এখানেই
শমশের গাজী অনন্য সবার চেয়ে আলাদা। এখানেই তার মহত্ত্ব। এজন্যেই তিনি যুগ যুগ ধরে
বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
পাদটীকা: বাংলার নবাবের পক্ষে মীর হাবিব ১৭২৯ সনে ত্রিপুরা সমতল ভূমি জয় করেন।
যা বর্তমানে শহর কুমিল্লা এবং এর আশেপাশের এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। এ সংবাদ শ্রবণে
নবাব সুজাউদ্দিন এ অঞ্চলের নামকরণ করেন রোশনাবাদ অর্থাৎ আলোকের দেশ। এর পূর্ব
থেকে অবশ্য পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যটি “উদয়পুর সরকার” নামে বাংলার নবাবের অধীনস্ত
ছিল এবং ত্রিপুরার রাজা বাংলার নবাবকে নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করতেন। মীর হাবিব
কর্তৃক ত্রিপুরার সমতল ভূমি বা রোশনাবাদ জয় করার পর নবাব নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে
ত্রিপুরা রাজাকে তার জমিদারী বন্দোবস্ত প্রদান করেন।
তথ্যসূত্র:
১. শমশের গাজী - আহমদ মমতাজ, প্রকাশনায় বাংলা একাডেমি -২০১৩, ২. তিন হাজার
বছরের নোয়াখালীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস - কাজী মোজাম্মেল হক, প্রকাশনায় হীরামন
প্রকাশনী -১৯৮২, ৩. আহদিসুল খাওয়ানিন - মৌলভী হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর, অনুবাদ-ড.
খালেক মাসুকে রাসুল প্রকাশনায় অনুপম প্রকাশনী -২০১৩, ৪. শমশের গাজী ইতিহাসের
অজ্ঞাত পৃষ্ঠা - আব্দুল কুদ্দুস স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদনায় মামুন সিদ্দিকী -২০০২, ৫.
কিংবদন্তীর ঢাকা - নাজির হোসেন, প্রকাশনায় আজাদ মুসলিম কাব (৩য় সংস্করন) -১৯৯৫,
৬. ঢাকা স্মৃতি - বিস্মৃতির নগরী - মুনতাসীর মামুন, প্রকাশনায় অনন্যা -১৯৯৩, ৭.
রাজমালা - কৈলাশ চন্দ্র সিংহ - সম্পাদনায় ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী ও পূরঞ্জন
প্রসাদ চক্রবর্তী, প্রকাশনায় পারুল প্রকাশনী -২০০৯, ৮. নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা - আবুল
কালাম মো. যাকারিয়া, প্রকাশনায় প্রথমা প্রকাশনী -২০১৫, ৯. ঢাকার ইতিহাস -
যতীন্দ্র মোহন রায়, প্রকাশনায় গতিধারা -২০১২, ১০. শমশের গাজীর বিদ্রোহ (নাটক) -
আহমদ কবীর, প্রকাশনায় লায়লা প্রকাশনী -১৯৯৯, ১১. কুমিল্লা জেলার ইতিহাস - আবুল
কালাম মো. যাকারিয়া, প্রকাশনায় কুমিল্লা জেলা পরিষদ -১৯৮৪, ১২.
তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙ্গী - ইউসুফ আলী খান অনুবাদ আবুল কালাম মো. যাকারিয়া
- ১৯৯৭, ১৩. মোঘল রাজধানী ঢাকা - ড. আবদুল করিম অনুবাদ ড. মুহিবউল্যা সিদ্দিকী,
প্রকাশনায় জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন -২০১২।
লেখক পরিচিতিঃ সংগঠক ও গবেষক
মতামত জানাতে ০১৭১১ ৩৯ ৩৮ ৫৭

মূল লেখার লিংক 
https://vusukupa.blogspot.com/2019/07/blog-post_37.html?m=1