সোমবার, ১০ জুলাই, ২০১৭

দেহ, কাম এবং প্রেমসম্পর্কিত একটি সত্যানুসন্ধান || পর্ব-১

প্রাকৃতিকতা

কাম হচ্ছে উৎসব— ইচ্ছার, ইন্দ্রিয়ের, আধারের, বিহ্বলের। কাম হচ্ছে কবিতা— শরীরের, স্নায়ুর, গতিভঙ্গির, নৈকট্যের। তার মুদ্রাগুলো হলো ছন্দ, অনুপ্রাস, অন্ত্যমিল। কাম যৌনতার, যৌনতা জীবনের, জীবন পৃথিবীর। যৌনতার একচ্ছত্র ও অনুপম রূপক হচ্ছে কাম, আর যৌনতা জীবনের। কাম ধ্বংসাত্মক, কেননা তা অভিদমনের সুপ্ত শক্তি হয়ে ভয়ংকর যুদ্ধের দিকে যায়। কাম আসলে প্রাণীকে অদৃষ্টপূর্ব একটি প্রপঞ্চ উপহার দেয়, যা প্রাণী জানে বা জানে না কিন্তু এর মধ্যেই নিহিত থাকে তার অস্তিত্ব এবং আস্তিত্বিক অগ্রগমন। পৃথিবীর সকল দর্শন হলো অনেকটা অনস্তিত্বের আবিষ্টতা বা হাওলাতি, কিন্তু কাম এমন এক দর্শন যা এককভাবে অস্তিত্বের গুণগান করে। শুধু তা-ই নয়, তা অস্তিত্বকে রক্ষা ও সম্প্রসারণ করেও চলে। এটাই একমাত্র ক্রিয়া যাতে সকলে বিশ্বাসী। সন্তান উৎপাদনে যারা অবিশ্বাসী বা অনন্বিত, তারাও এটাতে বিশ্বাসী। যৌনতা হচ্ছে এমন এক দর্শন যা জীবনাভিমুখী। সাধারণত দর্শন হলো, যা বস্তু ও জগতের রহস্যকে অনুসন্ধান ও ক্ষেত্র বিশেষে উন্মোচন করে। যৌনতার দর্শন হলো জীবনের রহস্যকে রক্ষা ও অনুশীলন করে যাওয়া যাতে রহস্য আরও চাগিয়ে ওঠে।

কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য কী? জীবনের উদ্দেশ্য নির্ভর করে জাতকের ওপর এ অর্থে যে জাতকই ঠিক করে তার জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে। কিন্তু প্রানিজগতে জীবন অসংখ্য, তাদের সমবেত উদ্দেশ্যও অবোধগম্য। তবে সামগ্রিক প্রাণিজগৎকে বিবেচনা করলে বলা যায়, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, অর্থাৎ তার সংরক্ষণই হয়তো জীবনের প্রাকৃতিক। জন্মের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রাণীর যে-সময় পরিসর তা-ই জীবন। রেমি দ্য গুরমতঁ বলেছেন, জীবনের উদ্দেশ্যে-সংক্রান্ত তথাকথিত ধারণাটি আসলে এক মানবীয় বিভ্রম, কারণ এই হেতুর ধারাবাহিকতার কোনো শুরু বা মধ্য বা সমাপ্তি নেই। তার মানে হলো, এক ধরনের আপতন ছাড়া জীবনের উদ্দেশ্য বলতে আসলে কিছু নেই। যা আছে তা বস্তুত যা ছিল তার হেতু, আর যা হতে থাকবে তা আসলে যা আছে তার হেতু। অস্তিত্ব অস্তিত্বের পুরোগামী। এখানে নেই কোনো শুরু বা শেষ। জন্মের দ্বারা যে-জীবন তা জন্মই দিতে থাকে জীবনের। ঘটে পরিবর্তন, একের স্থান দখল করে অন্যে, পালন করতে থাকে দায়িত্ব। শেক্সপিয়র তাঁর সনেটে বলেছেন : যা যায় পরেরটা তার স্থান দখল করে, নিজস্ব নিয়মেই সবাই ছুটে যায় সম্মুখপানে, আগের যৌনতার ঢেউ মুছে যায় পরের ঢেউয়ের আঘাতে। একজন সাধারণ মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে, তাহলে মুহূর্ত বিলম্ব না-করেই সে উত্তর দেবে যে তা হলো বংশরক্ষা করা। এই উত্তরটি আসলে এক ধরনের যৌনবিনয়। মানুষটি একটি নিষ্ক্রিয় উত্তর দিচ্ছে যা ঢেকে রাখছে তার কামলিপ্সাকে, যেন কাম নয়, দরকার প্রজনন। একজন তরুণী, স্বাস্থ্যবতী  হলে সরলভাবে এবং অনায়াসেই স্বীকার করবে যে সে বিয়ে করতে চায় সন্তান জন্ম দেবার জন্য। এই সামান্য সূত্রটিই হলো প্রকৃতির কিংবদন্তি, বলেছেন রেমি দ্য গোরমঁত। প্রাণীও চায় প্রজনন। ক্ষণজীবী রাতপতঙ্গ সন্ধ্যায় জন্ম নেয়, সঙ্গম করে, তারপর স্ত্রী-পতঙ্গ ডিম পাড়ে, সকালে সূর্যদর্শন না-করেই উভয়ে মরে যায়। জন্মের পর শুরু হয় যৌনজীবন, কারও বেশ আগে কারও বা পরে। কারও বা সবল যৌনতা, কারও বা দুর্বল। এই যে পরাক্রমশালী সিংহ তার যৌনাকাঙ্ক্ষা বা যৌনসক্ষমতা খুব কম। সঙ্গমকাল অতি স্বল্পস্থায়ী, শুক্রাণু স্খলনও কম। ফলে তিন দিন ধরে ক্ষণস্থায়ী মিলন আর সারাজীবনে মাত্র তিন বছর হলো তার সঙ্গমকাল। কম তার কামসৌন্দর্যও। আবার ড্যামসেল ফ্লাই সামান্য এক ফড়িং, সারাবছরই তাদের প্রজননঋতু, তাদের মিলনও প্রেমে ভরা, মিলনের আর্তি অদ্ভুত শৈল্পিক; পূর্বরাগের শুরুতে তারা উড়ে যায় কোনো জলাধারের দিকে, বসে কোনো অর্ধনিমজ্জিত উদ্ভিদের ওপর, আবার কখনও উড়ে বেড়ায় জলের ভূভাগে, নিজেকে করে তোলে পরিচ্ছন্ন, তারপর পরিষ্কার দেহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে পুরুষটি তার কাঙ্ক্ষিত নারীটির জন্য, পেলে তাকে নিয়ে মৌতাতে মেতে ওঠে, মনোরঞ্জন চলে বহুক্ষণ, তারপর সম্মতি পেলে মিলিত হয় দোঁহে। অদ্ভুত সৌজন্য আর বিনয় তাদের যৌনাচরণে। কিন্তু এসব কিছুরই উদ্দেশ্য বংশবৃদ্ধি। সুতরাং তর্কাতীতভাবেই বলা যায়, জীবনের উদ্দেশ্য হলো তার বহমানতা বজায় রাখা। প্রাকৃতিক যে জীবন সেখানে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এই জীবন সরলরৈখিক। আত্মসংরক্ষণ এখানে প্রজনন যা প্রাণীটির প্রতিরূপ সৃষ্টি করে যাতে সে নিজেকে খুঁজে পায়। এই যে অবস্থা তাকে বলা যায় প্রকৃতিতে প্রাণীর অবস্থা। এটা কোনো নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অবস্থা নয়, এটা এক শারীরবৃত্তীয় অবস্থা। এবং এটা প্রকৃতির কোনো তুঙ্গ অবস্থাকে বোঝায় না বরং এটাই প্রকৃতি।

‘জ্ঞানী, ব্রাহ্মণ ও অজ্ঞানী শুদ্র একই দিঘিতে স্নান করে। ময়ূর ও কাক একই পুষ্পলতাকে অবনমিত করে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও অন্যরা একই নৌকা করে নদী অতিক্রম করে। তুমি বেশ্যা, দিঘি, লতা, এবং নৌকার মতো সকলের সেবা করো।’— শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক-এ যা বলা হয়েছে, তার বিষয় হচ্ছে কাম, বিষয়ী হচ্ছে নর-নারী। ফ্রয়েড তাঁর মনোযৌনতা তত্ত্বে অবতারণা করেছেন লিবিডো-ধারণার যা জন্মের পর থেকেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ডব্লিয়ো. মরিস বলেছেন, ‘আমি মনে করি, স্বর্গ বা নরকের জন্য আমার জন্ম হয়নি, হয়েছে এই পৃথিবীর জন্যই।’ কাম, আকাঙ্ক্ষা ও তাড়নায়, একটি সর্বব্যাপ্ত প্রপঞ্চ যা বহন করে চলেছে প্রাকৃতিক ও মানব-সৃজনকে। জীবনের ব্যক্তিমানুষ থেকে সামষ্টিক সমাজ-সভ্যতার সংজ্ঞানে রয়েছে এই স্পর্শতীব্রতার ঝাপটা। শুধু মানুষ নয়, প্রাণীজগতের মধ্যেই রয়েছে এই ঝড় ও তীব্রতা। বিশাল প্রাণীকূলে রয়েছে যৌনবৈচিত্র্য। আর এই যৌনরীতিতে রয়েছে ব্যাপকতা। প্রাণীজগতে রয়েছে অদ্ভুত কামাচার যা শুধু দর্শন, নাচ-গান বা শ্রবণনির্ভরই নয়, গন্ধনির্ভরও; কখনও বা তা আচার-আচরণনির্ভরও। যৌনমিলনের মাধ্যমেই প্রাণীজগৎ তাদের জীবন্ত প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারে, যৌনতা আসলে প্রাণীদের অস্তিত্ব রক্ষার উপায় ও উদ্দেশ্য। প্রাণীদের যৌনাচারেও আছে ভিন্নতা ও ব্যাপকতা। দেখা মেলে নান্দনিক কামপর্বের যেখানে থাকে পূর্বরাগ ও প্রেমাভিনয়, থাকে যৌনমত্ততা ও মিলন। এসব গান্ধর্বিক তৎপরতায় থাকে শব্দ, গান, নাচ, দৈহিক রূপান্তর, গন্ধ প্রভৃতির ব্যবহার। আবার মিলনে যে আনন্দই থাকে তা-ই নয় থাকে ঝুঁকিও: যৌনসংসর্গ কষ্টের এমনকি মৃত্যুরও কারণ হয় কখনও কখনও। প্রজননের কাছে এভাবেই ঘটে প্রাণীর শহিদত্ব। কাম হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত রূপক, কিন্তু কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে তা বেদনা ও মৃত্যুরও রূপক। বিড়ালের ক্ষেত্রে দেখা যায় যৌন-সংসর্গে রক্তাক্ত হয় মেনি বেড়াল, চিৎকার করতে থাকে সে, কারণ হুলো বিড়ালের শিশ্ন-কাঁটায় রক্তাক্ত হয় তার জরায়ু ও যোনিপথ। মেনি বিড়াল তখন করুণ সুরে জুড়ে দেয় কান্না যাকে বলা হয় বিড়ালের কান্না। কিন্তু এই কষ্ট ভুলে যায় তারা, আবারও মিলনে হয়ে ওঠে আগ্রহী। কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে সঙ্গম মৃত্যুও ডেকে আনে: রেশমমথ সঙ্গমের পর পুরুষ মথ কয়েক মিনিটের মধ্যে মরে যায়। আবার গঙ্গা ফড়িংয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সঙ্গমের এক পর্যায়ে তীব্র উত্তেজনায় মশগুল পুরুষটির মাথা কামড়ে তাকে মেরে ফেলে স্ত্রী গঙ্গা ফড়িং। মৌমাছিদের মধ্যে সবাই পায় না যৌনতার স্বাদ, সৈনিক মৌমাছিরা আজীবন শুধু কাজ করে যায়, তাদের নেই কোনো কামসুখ পাওয়ার সুযোগ। রানি মৌমাছিকে পাওয়ার ঊর্ধ্বে ওড়ার প্রতিযোগিতায় থাকে কিছু-সংখ্যক পুরুষ মৌমাছি, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে করতে সবাই মরে যায়, শুধু টিকে থাকা একজনই করতে পারে সঙ্গম, এবং সঙ্গমের পর সেও মারা যায়। স্যামন মাছের ভাগ্যও এমন। পুরুষ হিপোক্যাম্পাস বা সাগরঘোড়া প্রজনন ঋতুতে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় সঙ্গিনীকে। দেখা পাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় নৃত্য। চলে পারস্পরিক সঙ্গ। এভাবেই নাচ-গানে কয়েকদিন যাওয়ার পর কোনো এক সময় পুরুষ হিপোক্যাম্পাস ঘুমিয়ে পড়লে সুযোগ বুঝে স্ত্রী হিপোক্যাম্পাস গোপনে পুরুষটির পেটের থলির ভেতর ডিম পেড়ে চলে যায়। জেগে ওঠে পুরুষটি খুঁজতে থাকে স্ত্রীটিকে কিন্তু আর পায় না। পুরুষটি বাধ্য হয়ে মাতৃত্বকে বহন করতে থাকে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা আসার সময় হলে শুরু হয় তার গর্ভযন্ত্রণা। অবশেষে বাচ্চাদের জন্ম দিয়ে সে মারা যায়। ফাইটার মাছ নিজেদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ কায়েম করে। এই মাছেদের পুরুষেরা পরস্পর যুদ্ধে মেতে থাকে এবং দুর্বলেরা এক সময় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। জয়ী পুরুষটি অবশেষে পায় নারীটিকে। এক জনের কামবাসনা পূর্ণ হয় অনেকের মৃত্যুর উপহারে। বলা চলে, কাম হচ্ছে এক ধ্বংসাত্মক মত্ততা যা সহজাত প্রবৃত্তির পথ ধরে দানা বাঁধতে থাকে এবং কখনও কখনও আত্মধ্বংসে সমাপ্তি টানে। শুধু তা-ই নয়, কাম অন্ধ এবং উদ্যত। যৌনবিনয়ের যে ব্যাপারটি এখন চোখে পড়ে তা কৃত্রিম এবং তা এক ধরনের মিথ্যার আবরণ ছাড়া আর কিছু নয়। এবং মুহূর্তেই তা খসে পড়ে, দেখা দেয় বিপর্যাস যা মানুষ এবং প্রাণীকে করে তোলে অযৌক্তিক, উন্মাদক, স্বৈরাচারী। যৌনবিনয়ের ধারণার পেছনে রয়েছে কামক্রিয়ায় নিস্ক্রিয়তার কারণটি যা নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যেত। আরিস্তোতল বলেছেন, পুরুষ সক্রিয় আর নারী নিষ্ক্রিয়। কিন্তু এখন এর অপনোদন হয়েছে, নারীরাও হয়ে উঠেছে অধিক সক্রিয়। তবে এই কামস্বৈরিতা অন্য প্রাণী অপেক্ষা মানুষের মধ্যে বেশি প্রকটিত। এর কারণ কী? সাধারণ ও প্রসারিতভাবে অস্তিত্বসম্পন্ন প্রতিটি সুসংবদ্ধ প্রাণী এমনকি উদ্ভিদেরও রয়েছে একটি শক্তিকেন্দ্র বা পাওয়ার হাউস যা নিয়ন্ত্রণ করে তার জীবনকে, আর তা হলো তার স্নায়ুতন্ত্র। এটি এমন এক অগ্রগামী বাহিনি যা একই সাথে শরীর ও মনকে সংবদ্ধ করে তোলে তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। এই স্বৈরিতা মানুষ অপেক্ষা প্রাণীরা বেশিমাত্রায় উপভোগ করে কারণ তাদের স্নায়ুকেন্দ্রিক শক্তি অল্প-সংখ্যক অভীপ্সাকে বাস্তবায়ন করতে চায়, অনেক সময় তা শুধু অস্তিত্বের প্রতিরূপ সৃষ্টির আকাক্সক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু মানুষের স্নায়ুকেন্দ্র একই সময় অনেক কিছুকে বাস্তবায়ন করতে চায়। ফলে তার কামস্বৈরতা হয়ে পড়ে নানামুখীন ও মাত্রাতিক্রান্ত। এ কারণেই অন্য প্রাণীদের কাম যেখানে স্বস্থ ও সরলতাময় মানুষের ক্ষেত্রে তা অস্বস্থ ও জটিল। বিষয়টা এ রকম হওয়ার পেছনে রয়েছে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও মস্তিষ্কের ক্রিয়া যাকে বলা হয় ‘এপিফেনোমেনন’। এ কারণেই প্রায় সারাজীবন ধরে কাম তাড়িয়ে বেড়ায় মানুষকে। এ যেন এক দৈত্যের ভর করা, যা মানুষকে অন্ধের মতো মত্ত করে রাখে। লুইস বুনুয়েল তাঁর আত্মজীবনীতে বলছেন, সারাজীবন যৌনক্ষুধায় তাড়িত থেকে বৃদ্ধকালে যখন তা থেকে মুক্তি মিলল, মনে হলো যেন ভর করে থাকা এক দৈত্য নেমে গেল শরীর থেকে। প্লাতোনের রিপাবলিক-এও দেখা যায় কাম থেকে মুক্তির স্বাচ্ছন্দ্যের কথা: সোক্রাতেস বলছেন, একবার সফোক্লেসের সাথে যখন তাঁর সাক্ষাৎ হলো তখন একজন এসে যৌনসংসর্গ বিষয়ে সফোক্লেসের কাছে অভিমত জানতে চাইল, জিজ্ঞাসা করল, এখনও নারীর সাথে তিনি সঙ্গম করতে সক্ষম কি না? উত্তরে সফোক্লেস জানাল, উন্মাদ আর বর্বর মনিবের কাছ থেকে রক্ষা পেলে ক্রীতদাস যেমন বেঁচে যায় তেমনি যৌনতা থেকে রক্ষা পেয়ে তিনিও বেঁচে গেছেন। দুটো উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে কাম নামক দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে তাঁরা যেন বেঁচে গেছে।

যৌনতার সাঙ্গীকরণে প্রাণীজগতেও দেখা যায় শরীর নির্বাচনের ভিন্নতা ও অভিনবত্ব, তবে কামের মঞ্চে বেঁচে নেওয়া হয় একটি শরীরকেই। শীতকালে, প্রজননঋতুতে, পুরুষ পেঙ্গুইন বসে থাকা অনেক নারী পেঙ্গুইনদের মধ্য থেকে ঘুরে ঘুরে একজনকে পছন্দ করে তার কাছে উপহার দেয় এক টুকরো নুড়িপাথর। নারী-পেঙ্গুইন তা গ্রহণ করলে অসংখ্য পেঙ্গুইনের মধ্যে  শুরু হয় তাদের কামপর্ব। পেঙ্গুইনের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঘর-সংসার করার প্রবণতাও দেখা যায়। পাখিরা প্রজননঋতুতে করে যৌন-পরিযান। নিজেকে আকৃষ্ট করার জন্য করে গান, বাঁধে গলায় সুর, কেউবা করে নৃত্য। কামবার্তা প্রেরণের জন্য বিজ্ঞাপন সিগন্যালও হয় নানারকম : শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য ইত্যাদি যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাসায়নিক সংজ্ঞাবাহ হিসেবে কামক্ষুধার বার্তা পৌঁছে দেয় অন্যদের কাছে। প্রাণীজগতে সঙ্গমকালও হয় নানারকম, কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে দীর্ঘ, কারও ক্ষেত্রে স্বল্প। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে নেকড়ের সঙ্গমকাল সবচেয়ে দীর্ঘ ও অটুট। সরীসৃপেরও সঙ্গমকাল হয় দীর্ঘ, কখনও কখনও তা অতি বিস্ময়কর : ঝুমঝুমি সাপ বা র‌্যাটল স্নেক দীর্ঘ বাইশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মৈথুন করে। আবার কারও বা সঙ্গমকাল মুহূর্তেও : ইঁদুর, বিশেষত সোনালি হ্যামস্টার ইঁদুরের এই সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু এখানেও রয়েছে বিস্ময়; এক ঘণ্টা বা তার বেশি কিছু সময়ের মধ্যে তারা ১৫০-১৭৫ বার মিলিত হয়। জলহস্তির কামকর্ম নাকি পুঙ্খানুপুঙ্খ, তার যৌনজীবন পরিস্রুত জীবন, প্রাণীদের মধ্যে জলহস্তিই শৃঙ্গারচর্চা করে, সত্যিকার অর্থে যৌনকর্মকে উপভোগ করে। বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিক মারিয়ো বার্গাস যোসা এ বিষয়ে বলেছেন অনবদ্য কথা : আমি জলহস্তির মতো যৌনকর্মে আগ্রহী। ...জানি, এটা কুৎসিত, রূঢ়, এক ধরনের পাশবিকতা রয়েছে এর মধ্যে, কিন্তু বাস্তবে আসলে তা খুবই স্পর্শকাতর।

কিন্তু মানুষের যে কামপ্রবণতা, অন্য প্রাণী থেকে তার রয়েছে ভিন্নতা। একমাত্র মানুষই কামের ক্ষেত্রে সচেতনতা আরোপ করে ফলে অর্থবহ হয়ে ওঠে তার কাম। শারীরিকভাবে দেখলে অন্য প্রাণীদের চেয়ে মানব জাতির মধ্যেই দেখা যায় ধারাবাহিক কামসক্ষমতা। একমাত্র মানবীই পারে প্রতিনিয়ত যৌন উত্তেজিত হতে। প্রতিদিনই সে কামাচারে লিপ্ত হওয়ার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা রাখে, এমনকি গর্ভকালীন সাবধানতায়ও সঙ্গম করার ক্ষমতা রাখে। সন্তান জন্মদানের কিছুদিনের মধ্যেই নারী হয়ে ওঠে সঙ্গমের জন্য উপযুক্ত। সকল প্রাণীরই যৌনমিলনের সুনির্দিষ্ট উষ্ণতার সময় আছে যখন তারা মিলিত হয়, তারপর তারা যৌনমিলন করতে পারে না। কিন্তু মানুষ সব সময়ই মিলিত হতে পারে, যখন সে ইচ্ছা করে। অন্য প্রাণীর স্ত্রীরা ঋতুকালীন সঙ্গমে সাড়া দেয় না, গর্ভকালীন যৌনক্রিয়া করতে পারে না। সন্তান হওয়ার পর সন্তানকে দুধ খাওয়ানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঋতুচক্র শুরু হয় না। প্রতিনিয়ত কামক্রিয়া করার এই যে সুবিধা এবং আকর্ষণ তা মানুষকে একত্র হতে সাহায্য করেছে শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে। কামস্বাচ্ছন্দ্যই বন্তুত মানুষকে করে তুলেছে অনুভূতিময়, প্রেমময়, সম্পর্কিত ও চেতনাময়। সুতরাং মানুষের জন্য কাম হচ্ছে সৃজনশীলতা, জীবনের এবং যাপনের, যা ধর্মীয় অর্থে বহাল থাকবে মৃত্যুর পর স্বর্গেও।

এই যে উৎসব প্রাণীজগতে ঘটছে অহরহ, তার প্রাকৃতিক দর্শনটা কী? এক কথায় এর উত্তর নেই, তবে তা হতে পারে অস্তিত্বগামিতার রূপকোদ্ভাস, হতে পারে অমরত্বের আভিপ্রায়িক উপাচার। কেউ কেউ বলেন, অমরত্বলাভের অভীপ্সা, যেমন সোক্রাতেসের দিয়োতিমা বলেছিলেন। দিয়োতিমা বলেন, পশুপাখি প্রজননের আকাঙ্ক্ষায় জ্বরগ্রস্ত হয়ে পড়ে, এমনকি তারা এর জন্য চরমমূল্য দিতেও কসুর করে না;  কারণ, নশ্বর প্রকৃতি যে-কোনোভাবে নিজেকে অবিনশ্বর আর চিরঞ্জীব রাখতে চায়, প্রজনন ছাড়া এর আর কোনো পথ নেই। আমরা জানি, জীবিত প্রাণী দু-ভাবে নিজেদের জন্ম দেয়: সাধারণ জীবসত্তা অযৌন প্রজননের আর জটিল জীবসত্তা যৌন প্রজননের মাধ্যমে। অযৌন প্রজননে, জীব, একক কোষ, তার বৃদ্ধির এক পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি একক সত্তা থেকে দুটো নিউক্লিয়াসের জন্ম হয় যা পরিণত হয় দুটো সত্তায়। আমরা বলতে পারি না যে একটি আরেকটির জন্ম দেয় বরং প্রথমটি থেকে দুটো স্বাধীন সত্তার আবির্ভাব হয়, আর প্রথমটি লীন হয়ে যায়। কিন্তু যৌন প্রাণীদের মতো তার মৃত্যু হয় না বা মৃত্যোত্তর পচন হয় না, তার অস্তিত্বের অবসান হয় মাত্র। তার অস্তিত্ব এমনভাবে থেমে যায় যেন তার আর কোনো প্রবহমাণতা থাকে না। কিন্তু প্রজনন প্রক্রিয়ার কোনো স্তরে তার আস্তিত্বিক প্রবহমাণতা ছিল। যৌন প্রাণীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রবহমাণতা ঘটে না, কারণ তার ক্ষেত্রে, প্রজনন, তাত্ত্বিকভাবে, মৃত্যু ও অপসৃতি প্রশ্নে স্বাধীন। কিন্তু যৌন প্রজননও আসলে অযৌন প্রজননের মতোই কোষ বিভাজন যা অচল থেকে প্রচলের নতুন ধরনের উত্তরণকে আনয়ন করে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু অপ্রবহমাণ অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে, তারা একত্র হয়, যার ফলে নতুন এক প্রবহমাণতার আবির্ভাব ঘটে যার মাধ্যমে আগের অবস্থার অবসানের মাধ্যমে নতুন সত্তা আবির্ভূত হয়। নতুন সত্তা নিজে অপ্রচল কিন্তু তার ভেতরে থাকে দুটো আলাদা সত্তার প্রচলের গতি ও একাত্মতা। এই একের ভেতর থেকে দুয়ের জন্ম হলে, নতুন দুটোতে সৃষ্টি হয় আস্তিত্বিক প্রবহমাণতা। অমরত্বের জন্য আকাঙ্ক্ষা ও প্রেম সকল জীবের মধ্যেই ক্রিয়াশীল। মানুষ উচ্চতর হতে থাকলে তার মধ্যেও এই প্রেরণা বেড়ে যেতে থাকে, সে তখন অমরত্বের প্রেমে পড়ে যায়। তখন  সে সঙ্গমের মাধ্যমে প্রজননে লিপ্ত হয়, মনে করে যে সন্তানের ভেতর দিয়েই তারা বেঁচে থাকবে, অথবা কিছু মানুষ জৈবিক সৃষ্টির পরিবর্তে আত্মিক সৃষ্টিতে মেতে ওঠে। এই অমরত্ব এক প্রতীকী অমরত্ব যা বোঝায় জীবনের চিহ্নায়ন ও সম্প্রসারণ এবং সংস্থাপন; নিজের গুণপনা, বাক্য ও ক্রিয়ার সংরক্ষণ। চৈনিক চেতনায় তা হলো মৃত্যুর পর ব্যক্তির থেকে যাওয়া গুণ বা কাজ বা বাচন, যাকে বহন করে উত্তর পৃথিবী। এজন্যই প্রজনন হলো প্রাণীর চরম লক্ষ্য আর তা অর্জিত হয় সবচেয়ে শক্তিশালী প্রবৃত্তি কামের দ্বারা। সবকিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে প্রজননইচ্ছা। হেসিয়োদ এবং পারমেনিদেস বলেছেন, কামস্পৃহাই হলো আদি সৃজনতত্ত্ব যা থেকে সবকিছুর সৃষ্টি। শোপেনহাওয়ার বলেছেন, কামস্পৃহাকে বলা যায় প্রজাতির আন্তরজীবন যাকে ঘিরে ব্যক্তি বিকশিত হয়। গাছের পাতা যেমন, গাছ যাকে পোষণ করে আবার পাতা গাছেরও পুষ্টি জোগায়। যৌনস্পৃহা এজন্যই বেপোরোয়া, তা নিহিত থাকে মানব বা প্রাণী প্রকৃতির গভীরে। এজন্যই কাম হচ্ছে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের অনুমোদন, কেননা তা জীবনস্পৃহা ও জীবনধারাকে বহন করার শক্তি ও সক্ষমতা।

কিন্তু যৌনতার বা কামের প্রাকৃতিক দার্শনিক ব্যাখ্যাটি একটি অপর ব্যাখ্যা যা অবরোহী যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, এবং যা প্রয়োজনভিত্তিক। কিন্তু বংশবৃদ্ধির এই যে প্রয়োজন তা সর্বজনীন না, ফলে তা কিছুটা হলেও খণ্ডিত। এছাড়াও আর একটি ব্যাপার আছে যাকে বলা যেতে পারে প্রাকৃতিক স্বতঃস্ফূর্ততা যা জীবনীশক্তির প্রকাশ, ভৌত নীতিকে অনুসরণ করে যা শরীরকেন্দ্রিক আন্তঃশারীরিক যোগাযোগ স্থাপন করে। সুতরাং কামের নৈতিক বা দার্শনিক তাৎপর্য অপেক্ষাও তার শারীরিক তাৎপর্য মূল্যবান।
.........চলবে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন