সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

বিজয়ের ৪৬ বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি


আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। একটি ভূখণ্ড, জাতীয় পতাকা এবং সার্বভৌমত্ব অনেক বড় নেয়ামত। ‘স্বাধীনতা’ নামক নেয়ামত থেকে যারা বঞ্চিত তারাই কেবল বুঝেন পরাধীনতার শৃঙ্খল কত বিষাদের। পৃথিবীর ইতিহাসে বিজয় ও বিজিতের ধারা চলমান। শাসন-শোষণের বিপরীতে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও সাধনা চিরকাল অব্যাহত আছে। প্রত্যেক জাতিকেই স্বকীয়তা ও অস্তি¡ত্ব লাভের আগে পরনির্ভরশীলতার ধাপটুকু অতিক্রম করতে হয়। আর এর জন্য কোনো কোনো জাতিকে দিতে হয় চরম মাশুল। আমাদের এই দেশ ও জাতির অস্তিত্ব লাভের পেছনেও এ পর্বটি পার হয়ে আসতে হয়েছে। অনেক কিছু বিসর্জনের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন জাতির অস্তিত্ব পেয়েছি।
আমরা কী হারিয়ে কী পেয়েছি-সেই প্রশ্নটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি রয়েছে। যেমন জাতীয়তাবোধ, দেশাত্মবোধ, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য। কোনো জনগোষ্ঠী নিজেকে স্বাধীন জাতি হিসেবে তখনই ভাবতে পারে যখন তার মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ, ঐক্য ও সংহতি, আত্মনির্ভশীলতা, আত্মবিশ্বাস এসব মৌল উপাদান মোটাদাগে থাকে। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি সদস্যের ওপর স্বাধীনতা সুরক্ষার পবিত্র দায়িত্ব বর্তায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য যেমন একজন নাগরিকের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকবে, তেমনি রাষ্ট্রের ইমেজ যেন কোনোভাবেই ক্ষুন্ন না হয় সেদিকেও থাকবে তার সতর্ক দৃষ্টি। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ থাকলেই কেবল একজন নাগরিক প্রকৃত অর্থে নাগরিকের মর্যাদা লাভ করতে পারে।
আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৪৫ বছর হয়ে গেল। আমাদের দেশটি আজ ৪৫বছরে পা রাখছে। জাতীয়ভাবে যৌবনের ধাপ পেরিয়ে পৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে আমরা। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের প্রত্যাশার দিগন্ত যতদূর বিস্তৃত ছিল সে তুলনায় প্রাপ্তির খতিয়ান কি সন্তোষজনক! একসাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের স্বপ্ন ছিল বিশাল, প্রত্যাশা ছিল দিগন্তপ্রসারী। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মনের মতো করে সবকিছু গড়বো, দেশকে সাজাবো অপরূপ সাজে, আমার মাতৃভূমি সবুজ শ্যামল এই বাংলা হয়ে উঠবে একটি স্বপ্নপুরী, জাতি হিসেবে আমরা আসীন হবো শ্রেষ্ঠত্বের আসনে-এসব নানা সুখ-ভাবনায় আমরা ছিলাম বিভোর। স্বপ্নের ঘোরে হারানো বেদনাকে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম অল্প দিনেই। সম্ভাবনার হাতছানি আমাদেরকে অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগই দেয়নি। কিন্তু আমাদের এই স্বপ্নের ঘোর কেটে যেতে বেশিদিন লাগেনি। সব স্বপ্ন হয়ে যায় ধূসর। যে প্রত্যাশা নিয়ে জাতি ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল সে প্রত্যাশার কিছুই পূরণ হয়নি। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তার কিঞ্চিৎও বাস্তবে পাইনি। স্বাধীনতার লাভের কিছুদিনের মধ্যেই এক চরম অরাজকতা সৃষ্টি হয়। চারটি বিজয় দিবস পালন করতে না করতেই দুর্ভাগ্যজনক ট্রাজেডি, ষড়যন্ত্র, ক্যু-পাল্টা ক্যু পরিস্থিতিকে বিষিয়ে তোলে। অস্থিরতা ও হতাশায় ছেয়ে যায় পুরো জাতি।
আমাদের এই স্বপ্নভঙ্গের কারণ ছিল অনেক। তবে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল নেতৃত্বের ব্যর্থতা। যারা সামনে থেকে, নেতৃত্বের আসনে বসে আমাদেরকে বিজয়ের মুখ দেখিয়েছিল তারাই আমাদের স্বপ্নভঙ্গের প্রধান কারণ। তাদের বিজয়ের পূর্বের ও পরের আচরণের মধ্যে তফাৎ ছিল বিস্তর। বিজয়ের পূর্বে যারা জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন, বিজয়ের পর তারাই জনধিকৃত হলেন। ক্ষমতার মোহ তাদেরকে উম্মাদ করে তুলল। ‘এসো ভাই লুটেপুটে খাই’ এই নীতিই তাদের কাছে প্রাধান্য পেল। তাদের চারপাশে জড়ো হয়ে থাকা চাটুকারেরা দেশের সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারায় মেতে উঠল। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটাকে পুনর্গঠনের পরিবর্তে নিয়ে গেল চরম বিপর্যয়ের মুখে। ফলে লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এদেশ বিশ্বের দরবারে খেতাব পেল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে।
সে সময় ক্ষমতা ও লুটেপুটে খাওয়ার যে রাজনীতির সূচনা হয়েছিল তা দিন দিন বেড়েই চলছে। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে অনেকবার। শাসননীতিরও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি জনগণের ভাগ্যের। পূরণ হয়নি তাদের প্রত্যাশা। বাস্তবে রূপ লাভ করেনি তাদের স্বপ্ন। ইতোমধ্যে আমরা পেরিয়ে এসেছি বিজয়ের ৪৫টি বছর। এখনও এদেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। সীমান্তে লাশ পড়ে পাইকারি হারে। আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় বিশ্ব মোড়লেরা। প্রতিবেশী দাদাদের ইশারায় নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর লোলুপ দৃষ্টি এদেশের ওপর নিবদ্ধ। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত। দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। না খেয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। ন্যূনতম চিকিৎসার অভাবে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে অসংখ্য লোক। পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এদেশের সিংহভাগ শিশু। শুধু রাজধানীতেই ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, শিক্ষা, চিকি ৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি আজও নিশ্চিত হয়নি। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা আমাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। ক্ষমতায় থাকা আর যাওয়ার নোংরা ও হিংস্র প্রতিযোগিতায় এ জাতির জীবন আজ ওষ্ঠাগত। সন্ত্রাসের কাছে আমরা সবাই জিম্মি। দুর্নীতিতে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কয়েকবার হ্যাট্রিক করেছি। প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে এখনও বিতর্ক হয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কিনা। ইসলামকে কষে গালি দিলেও এর তেমন কোনো শাস্তির বিধান নেই এদেশে। ধর্ম-কর্ম পালনেও আজ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকারই এখনও এদেশে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যারা রক্ষক তারাই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। তথাকথিত রাজনীতিবিদরা নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক দাবি করলেও তাদের অনেকের কা-কারখানা জাতিকে লজ্জায় নুইয়ে দেয়।
বিজয়ের চার দশক পরও যে এসব দেখতে হবে তা আমরা আগে ভাবিনি। বিজয়ের স্বপ্ন এভাবে ধূলিস্মাত হবে জানলে চড়ামূল্যের এই বিজয় আমরা আনতাম কিনা তা বিবেচনা করা যেত। যাঁরা রক্ত দিয়ে, নিজের অমূল্য জীবন দিয়ে আমাদেরকে এ বিজয় এনে দিয়েছেন তাদের কাছে আমরা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। ৪৫ বছর সময় কম নয়, স্বপ্নীল দেশ গড়ে তোলার জন্য এতটুকু সময়ই যথেষ্ট ছিল। আমাদের পরে বিজয় অর্জন করে অনেক দেশ চলে গেছে আমাদের চেয়ে বহুদূরে। এই সুদীর্ঘ সময়েও না পারা আমাদের চরম ব্যর্থতা। জাতি হিসেবে এটা আমাদের দীনতার প্রমাণ বহন করে।
আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়েছি। কিন্তু আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গতিটা আশানুরূপ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলেও অনেক ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। একটি জাতির টিকে থাকার যে নৈতিক ভিত্তি আদর্শ ও নৈতিকতা তাতে চরম ধস নেমেছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে স্খলনের মাত্রা যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলেছে তাতে কোনো রকম দাঁড়িয়ে থাকা নৈতিকতার স্তম্ভটিও ধসে পড়বে। ৪৫ বছর আগে আমরা জাতীয়ভাবে যতটা নৈতিকতার বলে বলীয়ান ছিলাম তা কিন্তু এখন নেই। সেই সময়ের মানুষদের মধ্যে অন্যায় ও পশুপ্রবৃত্তির এতটুকু উপস্থিতি ছিল না যা এখন আছে। আত্মপ্রতিষ্ঠা ও লোভের লাগামহীন ঘোড়া আমাদের কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারবে না। বাহ্যিক সূচকগুলোতে আমরা যতই এগিয়ে যাই নৈতিকতার ভিতটি নড়বড়ে হয়ে গেলে এ জাতির পতন অনিবার্য। এজন্য বাহ্যিক উন্নতির পাশাপাশি নৈতিক উন্নতির বিষয়েও ভাবতে হবে সবাইকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন