মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস : মনে উঁকি দেয়া কিছু প্রশ্ন করা যাবে কী?

শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস( ১৪ ডিসেম্বর)
কিছু প্রশ্ন করা যাবে কি?
_____________________________________________
গতকাল ছিল১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় গতকালও হয়ত রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফুল দিয়ে গণহারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। রায়েরবাজারের গতকালের পরিবেশটা দেখলে মনে হবে, কতো না যত্ন করে এই জায়গাটাকে সুরক্ষিত এবং পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অবস্থা থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
সন্ধ্যা হলে কেন্দ্রীয় শহীদি মিনারে বসে গাজার আসর। এক দল বাউন্ডুলে গিটার গাধে নিয়ে গান ধরে, “গাজার নৌকা পাহাড় তলি যায়, ও মিরা ভাই! গাজার নৌকা পাহাড় তলি যায়! গাজা খাব আটি আটি, মদ খাব বাটি বাটি”। সেখানকার অবস্থাটা এমন যে, সম্ভব হলে শহীদ মিনারের বুকেই গাজার চাষ শুরু করে দিবে কিংবা মদের বার খুলে বসবে! গাজার চাষ সম্ভব না হলেও মধ্যরাতে শহীদ মিনার হয়ে ওঠে অস্থায়ী মদের বার। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মাস আসলেই এই স্থানগুলো হয়ে ওঠে দেশের সর্বোচ্চ তির্থস্থান। তেমনি রাত হলেই রায়েরবাজার বধ্যভূমি হয়ে ওঠে নেশাখোরদের আশ্রয়স্থল। লোক মুখে শোনা যায় সেটি নাকি হিরোইনচিদের অভয়্যারন্য । প্রতি বছর এই গর্বের এই মাসগুলো আসলে প্রশাসনের যেমন টনক নড়ে তেমনি আমাদের মত চুনেপুটি ব্লগাররাও এসব নিয়ে স্বরব হয়ে ওঠে। তাই এই সব স্থানের সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিসহ আমাদের সকলের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করবার উদ্বার্ত আহব্বান জানিয়ে আমি মূল বক্তব্যে চলে যাচ্ছি।
এ যাবত পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড কারা ঘটিয়েছে তার সঠিক উত্তর জানা না গেলেও তার বিপরীতে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে যাচ্ছি! যে প্রশ্ন ইতিহাসই বার বার সমানে টেনে নিয়ে আসে। আর প্রশ্ন না থাকলে উত্তরও আসবে না। তাই ইতিহাসের সেই প্রশ্নগুলো আবারো সামনে নিয়ে আসার চেষ্ঠা করছি। যদি সম্ভব হয়, তাহলে তথ্যসহ উত্তর দিয়ে আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করবার অনুরোধ রইল।
সেই দিন যেসব বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলিম চৌধুরী। সেই আলিম চৌধুরীর বিষয়ে ইতিহাস বলে, “১৯৭১ সালে ডাঃ ও মিসেস আলিম চৌধুরী ঢাকায় পুরানা পল্টনে একটি তিনতলা বাড়িতে বাস করতেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলিম চৌধুরীর তিনতলা বাসার নিচতলায় ছিল তার নিজের ক্লিনিক ও উপরের দু’টি তলায় তারা নিজেরা বসবাস করতেন। ডাঃ চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক। আশ্চার্যের বিষয় হলো এই ডাক্তার পরিবারটি কট্টর পাকিস্তানী সমর্থক একজন আল বদর সদস্যকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার নাম ছিল মাওঃ মান্নান।
পরবর্তি মাসগুলোর দৈনন্দিন জীবনের যে বর্ণনা মিসেস আলিম চৌধুরী দিয়েছেন তা ছিল যুক্তিতর্কের বাইরের এক পরিস্থিতির বিবরণ। নীচতলায় পাক সেনারা যাওয়া-আসা করত মাওঃ মান্নানের কাছে এবং প্রায়দিনই তারা সেখানে থাকতো অনেক রাত পর্যন্ত। আল বদর সদস্যরা মাওঃ মান্নান ও ডাঃ চৌধুরীর গেট পাহারা দিতো। অন্যদিকে উপর তলায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন ক্লিনিকে আসতো ওখানে তাদের ফ্রি চিকিৎসা দিতেন ও প্রয়োজনে তারা ডাঃ আলিমকে গাড়িতে করে নিয়ে যেতো নিরাপদ স্থানে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরী মিসেস চৌধুরীকে ডেকে পাঠান ও জিজ্ঞেস করেন নীচতলায় আল বদরের আসা যাওয়া আর উপর তলায় মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা নিয়ে আপনারা কি ভেবেছেন? মিসেস চৌধুরী এর কোন উত্তর দিতে পারেন নি। কেন মাওঃ মান্নান কে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেন নি,মিসেস চৌধুরী”। ( শর্মিলা বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৪৯-১৫০ দ্রঃ)
কিন্তু সেই আল বদর সদস্য মাওঃ মান্নান পরবর্তিতে ডাঃ আলিম চৌধুরীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ান। সেই দিনের বিবরণ,“ মিসেস চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকায় ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রচন্ড গোলাবর্ষন করেছিল। ঠিক ঐ সময়ে গায়ে কাদা মাটি মাখানো ছোট একটি মাইক্রোবাস এসে থামে মাওঃ মান্নানের দরজার সমানে। এ ধরনের গাড়ি সেখানে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতো আর তাই এতে চৌধুরী পরিবারের লোকজন তেমন বিরক্ত বোধ করেন নি। ইতোমধ্যে দু’জন অস্ত্রধারী আল বদর সদস্য ডাঃ আলিম চৌধুরীর ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। ডাঃ চৌধুরী মাওঃ মান্নানের দরজায় অনেকবার ধাক্কা দিয়েছিলেন কিন্তু মাওঃ দরজা খুলেন নি। ওই দুই বন্দুকধারী ডাঃ আলিমকে নিয়ে চলে যায়। তার পরনে ছিল সাধারণ লুঙ্গি ও গায়ে ছিল বাসায় পরা জামা”। ( শর্মিলা বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৫১ দ্রঃ)
আর ডাঃ আলিমের ভাগ্যের বিপরীত ছিল না অন্যান্য ডাক্তারদের। “মিসেস চৌধুরী মিসেস ফজলে রাব্বীকে ফোন করলে তিনি জানান, ডাঃ ফজলে রাব্বীকেও একই সময়ে একই ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ডাঃ চৌধুরীর ভাই হাফিজ ১৭ ডিসেম্বর বাসায় ফিরে আসেন।
তারা সকলে ডাঃ চৌধুরীর সন্ধান করেন কিন্তু কেউ কোন খবর দিতে পারেন নি। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর তার মরদেহ রায়ের বাজার খোলা ইটের ভাটায় আরো অনেক বুদ্ধিজীবি ও বিভিন্ন পেশাজীবীর লাশের সঙ্গে পাওয়া যায় যারা ছিলেন বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৫১-১৫২ দ্রঃ)
হত্যাকান্ডের উপর মিথ্যা রিপোর্ট কেন?
বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডগুলো ছিল নিঃসন্দেহে নির্মম এবং ভয়াবহ। কিন্তু তারপরও হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলোকে সেই সময়ে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। যা আজও চলমান আছে। এতে করে বুদ্ধিজীবিদের প্রতি অতিরিক্ত সমবেদনা আদায় হয়েছিল কিনা তা জানা না গেলেও পরবর্তিতে সত্য প্রকাশিত হবার পর বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। সে সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ আলিমের দু’চোখ তুলে ফেলা হয়েছিল এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফজলে রাব্বির হৃদপিন্ড কেটে বের করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু স্বয়ং ডাঃ আলিম এবং ডাঃ ফজলে রাব্বির স্ত্রী বলেন ভিন্ন কথা!
মিসেস চৌধুরীর দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী,ডাঃ আলিম চৌধুরীর বুকে অনেকগুলো বুলেটের আঘাতের ছিল এবং বাম ললাট ও বাম তলপেটে ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আঘাতের চিন্হ ছিল যা দেখে মনে হয়েছিল তাকে বেয়োনেট দিয়েও আঘাত করা হয়েছে। তার পরনে ছিল সেই গেঞ্জি, জমা আর লুঙ্গি যা পড়া অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। মিসেস চৌধুরী দেখেছিলেন যে তার মুখমন্ডল অস্বাভাবিক কালো হয়ে গেছে। কিন্তু তার চোখ অক্ষত ছিল। সে খবর টি বেরিয়েছিল যে, তার চোখ তুলে ফেলা হেয়েছিল সেটি সঠিক নয়।
ডাঃ ফজলে রাব্বির মরদেহ সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী বলেন,“ তার বাম গাল ও তার কপালের বাম পাশে ছিল অসংখ্য বুলেটের চিন্হ। বুকেও অসংখ্য বুলেটের আঘাত ছিল তবে আমি তা গুনে দেখিনি। কিন্তু এটা ডাহা মিথ্যে কথা যে তার বুক চিরে ফেলা হয়েছিল। আমি সেই বুক দু’হাত দিয়ে ধরেছি ও দেখেছি।”।( শর্মিলা বসুর লেখা, ডেড রেকনিং পুস্তকের,পৃঃ১৫২ ও ১৫৬ দ্রঃ)
তাহলে বুদ্ধিজীবিদের হত্যার বিবরন নিয়ে এই মিথ্যাচার কেন?
বুদ্ধিজীবিদের আসল হত্যাকারী কারা?
দেশ স্বাধীন হবার পর ডাঃ চৌধুরীর পরিবার মাওঃ মান্নানের উপর হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। কিন্তু মাওঃ মান্নান অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে যান। তখন মাওঃ মান্নানের ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করে বলা হয়, একে ধরিয়ে দিন। মাওঃ মান্নান খন্ডকালীন সময়ে ধরা পড়লেও পরবর্তিতে অজানা কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই মাওঃ মান্নান পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তার নিজ মালিকানায় একটি সংবাদ পত্রও ছিল। এবং সবচেয়ে মজার বিষয় এই মাওঃ মান্নান পরবর্তি সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। (সূত্রঃ ডেড রেকনিং,পৃঃ১৫৪ দ্রঃ)
তাহলে প্রশ্ন হল, এই মাওঃ মান্নানকে কেন বিচারের মুখোমুখি করা হলো না?
এটা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও বিশ্বাস করা হয় যে, পাকিস্তান সেনাবহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি খান ছিলেন স্বাধীনতার সমর্থক বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের হত্যাকান্ডের মুখ্য পরিকল্পনাকারী। ধারণা করার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে তার লেখা বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের নামের তালিকা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশীদের হাতে পড়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকার গঠিত হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে বলা হয়েছে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড নিয়ে মেজর জেনারেল রাও ফরমান ও তৎকালীন ঢাকা জেলা প্রশাসক মেজর জেনারেল জামসেদকে জেরা করা হয়েছিল। তারা বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তালিকানুযায়ী তারা কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন। তবে মেজর জেনারেল রাও ফরমান পরামর্শ দিয়েছিলেন কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য। তাছাড়া গোযেন্দারা যে নামের তালিকা দিয়েছিল তা ছিল গেরিলা নেতাদের কোন বুদ্ধিজীবিদের নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় আক্রমন প্রতিহত করতে ব্যস্ত ছিল তাদের হাতে এতোটাও সময় ছিল না যে পরকিল্পনা করে কাউকে হত্যা করবে। (সূত্রঃ ডেড রেকনিং,পৃ,১৫৩দ্র)।
আর যদি ভাবা হয় বাঙালী পাকিস্তান পন্থিরা তাদের হত্যা করেছে তাহলে আরও কিছু কথা বলতে হয়। যুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর মুক্তিযোদ্ধারা পাইকারী হারে রাজাকার আল বদর নিধন শুরু করে। তখন বাঙাল রাজাকাররা নিজেদের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। তখন আর বদর বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যরাই ছিল পলাতক। আর এই সময়ে তাদের দ্বারা এরকম একটি প্ল্যানেড হত্যাকান্ড বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর ছিল না।( ডেড রেকনিং,পৃঃ ১৫৩-১৫৪ দ্র)
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও সেই হত্যাকান্ডের কোন তদন্ত করা হয় নি। সরকারীভাবে কোন উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। যা দেশ স্বাধীন হবার পরপরই করা উচিত ছিল। কিন্তু কেন করা হলো না???
ইতিহাসে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড নিয়ে সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে না পেলেও ইতিহাসের বুকে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম যাতে সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে প্রকাশ করে আমাদের বাধিত করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন