সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

শিক্ষক, শিক্ষার কৌশল ও স্টুডেন্ট সাইকোলজিো( ১ম অংশ)

শিক্ষা :
আভিধানিক অর্থে- শিক্ষা হচ্ছে, শেখা, অভ্যাস, অধ্যয়ন, জ্ঞানার্জন, চারিত্রোন্নতি। সু-অভ্যাস বা ক্রমাগত অনুশীলন শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। ল্যাটিন শব্দ Educo থেকে ইংরেজী Education  শব্দের উৎপত্তি।  Educo শব্দের মূলগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- E = Out; duco = to lead, to draw out বা পরিচালিত করা, বের করা, প্রতিভাত করা। Education এর তাৎপর্য হচ্ছে, মানব মনের সহজাত  বৃত্তি বা সম্ভাবনাকে বিকশিত ও পরিচালিত করাই শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ইউরোপীয় E (ই) উপসর্গের একটা অর্থ অভাব আর এক অর্থ বর্হিগমতা; Educate শব্দের উৎপত্তিমূলক অর্থ বহির্ণয়ন। এই অর্থ-সূত্রেই তিনি বলেছেন, “আমাদের যে শক্তি আছে তাহারই চরম বিকাশ হইবে, আমরা যা যাহা হইতে পারি, তাহা সম্পূর্ণভাবে হইব- ইহাই শিক্ষার ফল।” মোটকথা, মানুষের অন্তর্নহিত গুণাবলীকে স্ফুরিত, নিগরিত ও নিয়ন্ত্রিত করে জীবনের নানা প্রয়োজেনে তাকে উক্ত গুণগুলো প্রয়োগ করার শক্তি ও নৈপুণ্য দান করাই শিক্ষা। 

শিখন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্র:

বিখ্যাত শিক্ষা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম (Benjamin Samuel Bloom) দীর্ঘ গবেষণা করে ১৯৫৬ সালে শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়াকে তিনটি ক্ষেত্রে (Domain) ভাগ করেছেন :
১.    বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র  (Cognitive Domain)
২.    আবেগীয় ক্ষেত্র   (Affective Domain)
৩.    মনোপেশিজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain)
৪.    বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র  (Cognitive Domain): মস্তিস্কই আমাদের বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষেত্র। মানুষ কোন বই পুস্তক, পত্র-পত্রিকা পড়ে সিনেমা নাটক দেখে কোন অনুষ্ঠান বা আলোচনা শুনে নিজের মধ্যে যে জ্ঞানমূলক দক্ষতা তৈরি করে তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র বা চিন্তন দক্ষতার ক্ষেত্র বলে। এ ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তর রয়েছে -
                                                            মূল্যায়ন 
                                                  সংশ্লেষণ  
                                         বিশ্লেষণ  
                               প্রয়োগ
                   অনুবাধন
            জ্ঞান 
৫. আবেগীয় ক্ষেত্র   (Affective Domain): শিক্ষার্থীর আবেগেরে বিভিন্ন দিক ধীরে ধীরে গড়ে উঠে।
     যেমন-         
                                                                                  আত্মস্থকরণ (Internalizing)
                                                                মূল্যবোধ সংগঠন (Organizing)
                                              মূল্যবোধ  বিচারকরণ (Valuing)
                            সাড়া প্রদান (Respond)
                  গ্রহণ (Receiving) 
                                            
৬. মনোপেশিজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain) : এ ক্ষেত্রে মন এবং পেশির সমন্বয় করে শিক্ষার্থী কোন বিষয় হাতে কলমে শিখে। সকল ব্যবহারিক এবং ট্রেড জাতীয় বিষয এ শিখন ক্ষেত্রের আওতাভুক্ত। এ শিখন প্রক্রিয়াটি শিক্ষার্থীরা ধাপে ধাপে শিখে। নিম্নের চিত্রটি লক্ষ্য করি- 
                                                          স্বাভাবিকীকরণ (Naturalization)
                                             শিল্পিতকরণ (Articulation) 
                                   যথার্থকরণ (Precision)  
                 নিপুণতার সাথে কার্যসাধন  (Manipulation)
অনুকরণ (Imitation)   

শিক্ষা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম দেখিয়েছেন, শিখন প্রক্রিয়াটি যে ক্ষেত্রেই ঘটুক না কেন, তা ধাপে ধাপে বা  স্তরে স্তরে সম্পাদিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিক্ষাবিজ্ঞানী এ বিষয় আরও গবেষণা করে নতুন ধারনা প্রদান করেন। 
নিম্নের চিত্রটি লক্ষ্য করি -

শিক্ষক ও নেতৃত্ব:

The fifth discipline’ বইয়ে একটা উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, “Leader as teacher’ is not about ‘teaching’ people how to achieve their vision. It is about fostering learning, for everyone. Such leaders help people throughout the organization develop systematic understanding.” একজন শিক্ষক যখন কেবল মাত্র শিক্ষক তখন কেবলমাত্র পঠন-পাঠন কার্যক্রম পরিচালনা, মূল্যায়ন ও প্রশাসনিক নিয়মিত দায়িত্ব পালনই এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন নেতা, অর্থাৎ নেতৃত্বের গুণাবলির ছোঁয়া তার ভেতর থাকে তখন শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজেকে দাঁড় করাতে পারেন একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে।কাজেই শিক্ষককে তার শিক্ষণ-শিখন দক্ষতার সাথে নেতৃত্বের গুণাবলীও রপ্ত করা চাই।প্রথমত, একজন শিক্ষককে বর্তমানের প্রচলিত জ্ঞান সম্পর্কে নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে। একজন শিক্ষক তখনই একজন স্বার্থক শিক্ষক যখন তিনি একজন ““life-long learner’. শিক্ষকের জ্ঞান সম্পর্কে পিপাসা, সৃজনশীল মনোভাব এবং সময়ের সাথে শিক্ষকতার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজেকে পরিবর্তন করে চলা শিক্ষককে এগিয়ে নিয়ে যায় আরও অনেকখানি ধাপ উপরে। আর সেখানেই একজন শিক্ষক প্রকৃত অর্থে নেতা হয়ে উঠতে পারেন।দ্বিতীয়ত হল, যোগাযোগের দক্ষতা। একটা স্বার্থক শিক্ষণ-শিখন পরিবেশ গঠনের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক সঠিক তথ্যটি নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে তা শিক্ষার্থীদের সাথে আদান-প্রদান করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সময়োপযোগী জ্ঞান থাকতে হয়।You cannot learn unless you listen”.
কাজেই শুনতে হবে সহকর্মী থেকে শিক্ষার্থী সকলের কথা।
একজন ভালো শ্রোতা নতুন ধারণা, পদ্ধতি, নীতিমালা গ্রহণে সদা প্রস্তুত থাকেন। একই সাথে নতুন জ্ঞানকে গ্রহণ ও আদান-প্রদান করা, সহকর্মীদের সাথে একটা বিশ্বস্ত সম্পর্ক স্থাপন, রিসোর্স প্রভাইড করা, শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা, উপস্থাপনের দক্ষতা, শ্রেণীকক্ষে সহযোগী মনোভাব, বিদ্যালয়ে লিডারশিপ ধারণা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্পষ্ট জ্ঞান, পরিবর্তনশীল মনোভাব, প্রেষণা প্রদান, পরিকল্পনা প্রণয়ন, সাংগঠনিক দক্ষতা, সমন্বয় সাধনের দক্ষতা ইত্যাদিকে শিক্ষার্থীর সামর্থ্য বৃদ্ধিতে শিক্ষকের গুণাবলি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া :

শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ একটি দ্বিমুখী আনন্দময় স্বচ্ছন্দ প্রক্রিয়া। তাই শিখন শিখানো কথাটি দ্বিমুখী অর্থবহন করে। শ্রেণীতে পাঠদানের  দু’ রকম পদ্ধতি আছে-
১. শিক্ষক  কেন্দ্রিক    ২. শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক

শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষকের ভূমিকাই মূখ্য, এই পদ্ধতি গতানুগতিক ও বৈচিত্রহীন। এখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে না। আর শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর ভূমিকাই মূখ্য থাকে। শিক্ষকরা যদি উভয় পদ্ধতিতে পাঠদান করেন তবে যে সকল সুফল বয়ে আনবে তা হল -

    ক. শিক্ষার্থীকে বিষয়বস্তু অনুধাবনে সক্ষম করে তোলে। 
    খ. শিক্ষার্থীর মত প্রকাশের অনুভুতিতে নাড়া দেয়।
    গ. শিক্ষার্থীর আচরণের সাথে বিষয়বস্তুর একটা তুলনামূলক স্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। 
    ঘ. মুখস্থ করার প্রবনতা দূর হয় এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।

শিখন পদ্ধতি ও কৌশল :

আমাদের জীবনে অনেক শিক্ষকেরই প্রভাব রয়েছে। আমরা এখনও অনেক শিক্ষকের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ব্যক্তি মানুষটির জন্য নয়, পড়ানোর কৌশলের জন্য, যা আমাদের বিবেকবোধ, আবেগ অনূভূতিতে নাড়া দেয়। সুতরাং শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীর আচরণিক পরিবর্তনে শিক্ষক যে সকল শিখানো পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করতে পারেন, পরিবেশ ও শিক্ষার্থীর মান বুঝে তা অবলম্বন করা উচিত, যেমন-  
১. বক্তৃতা (Lecture)                   ২. বক্তৃতা  আলোচনা (Lecturette)   
৩. স্থান পরিদর্শন (Site Visit)        ৪.  প্রদর্শন (Demonstration)     
৫.  শিক্ষামূলক ভ্রমণ ও মাঠ পরিদর্শন (Study tour & Field work)
৬. দলীয় আলোচনা (Group Discussion)    
৭. প্যানেল ডিসকাশন (Panal Discussion)    
৮. ঘটনা বিশ্লেষণ (Case Study)    ৯. ব্রেইম স্টর্মিং (Brain storming)    
১০. ভূমিকানয়ন (Role Play)        ১১. পাঠ নির্দেশনা (Guided Study)
১২. সিমুলেশন খেলা (Simulation Play)        
১৩. প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি (Question-Answer Method)
১৪. সতীর্ত দলভিত্তিক শিখন (Peer Group Learning)
১৫. সমস্যা সমাধান (Problem Solving Learning)
১৬. পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষাদান (Interactive teaching).

অষ্ট্রেলিয়ার ৭০ বছর বয়স্ক একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, Learning just a fun অর্থ্যাৎ শিক্ষণ হচ্ছে একটা মজা। বস্তত: একজন শিক্ষক শিখন- শিখানো পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষাদান পরিবেশটাকে আকর্ষণীয়, আনন্দময় ও মজাদার করে তুলবেন। 
শিক্ষকের দায়িত্ব ফ্যাসিলেটেটর (Facilitator), স্যার জন এ্যাডমস শিক্ষককে “মানুষ গড়ার কারিগর” (A  Maker of Man)  বলেছেন, আবার  আধুনিক শিক্ষাবিদরা বলেন- শিক্ষক হচ্ছেন “ÒA Teacher is a Change Maker” অর্থাৎ পরিবর্তনকারী সমাজ ও শিক্ষার্থীর জীবন এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই ফলপ্রসু শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক ফ্যাসিলেটরের (Facilitator) অর্থাৎ সহায়তাকারীর ভূমিকায় অবর্তীণ হয়ে কিছু দায়িত্ব পালন করবেন।  
যেমন -       
১. সংগঠক   ২. উদ্ভাবক    ৩. শ্রেণী ব্যবস্থাপক  ৪. প্রদর্শক    ৫. পরিচালক        
৬.. ন্যায় বিচারক   ৭. উদ্ধুদ্ধকারী ৮. পরামর্শ দানকারী    ৯. অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ১০. পরিকল্পনাকারী    ১১. স্বপ্ন দ্রষ্টা।

একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দেবেন। জীবনের স্বপ্ন পূরণের কথা তিনি এ ভাবে বলবেন- “Dream is not what you see in sleep, is the think which does not let you sleep


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন