রবিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৫

হক ও বাতিলের সংঘর্ষ


হক ও বাতিলের সংঘর্ষ অনিবার্য কেন?

দুনিয়ায় যত নবী ও রাসূল এসেছেন তাঁদের সবাই দ্বীনে হক কায়েম করার দায়িত্বই পালন করে গেছেন। যে দেশে দ্বীনে হক কায়েম ছিল না সেখানে অবশ্যই বাতিল কায়েম ছিল। হক কায়েমের চেষ্টা করলে বাতিলের পক্ষ থেকে বাধা আসাই স্বাভাবিক। কারণ হক ও বাতিল একই সাথে চালু থাকতে পারে না। আলো ও অন্ধকারের সহ অবস্থান বাধা দিয়েছ্ েএকমাত্র আদম (আ) এবং সূলায়মান (আ) বাধার সম্মুখীন হননি। কারণ আদম (আ) এর সময় কোন মানুষই ছিল না, বাধা দেবে কে? আর সুলায়মান (আ) তাঁর পিতা দাউদ (আ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালক ছিলেন বলে তাঁকে বাধা দেয়ার মতো কোন বাতির শক্তি ছিলই না।

হকের আওতায় যে কালেমায়ে তাইয়েবার মারফতে পয়লা ঘোষণা করা হয় তার মধ্যে আল্লাহকে ইলাহ স্বীকার করার পূর্বে লা-ইলাহা বলে সমস্ত বাতিলকে অস্বীকার করা হয়। সমাজে ইলাহ বা মনিব বা হুকুমকর্তার দাবীদার বাতিল শক্তি কায়েম আছে বলেই পয়লা বাতিলকে অস্বীকার করা দরকার হয়। বাতিলকে মন-মগজে বলে কায়েম রেখে হককে স্বীকার করা অর্থহীন। তাই পয়লা লা-ইলাহা বলে সমস্ত বাতিল ইলাহকে অস্বীকার করে ইল্লাল্লাহ বলে একমাত্র আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

****************************************

অর্থ: “যে তাগুতকে অস্বীকার করলো এবং আল্লার প্রতি ঈমান আনল সে-ই মযবুত রজ্জু ধারণ করেছে। ”-(সূরা বাকরা: ২৫৬, আয়াতুল কুরসী)

তাগুত অর্থ হলো আল্লার বিদ্রাহী শক্তি। কাফের আল্লাহকে অস্বীকার করে মাত্র। কিন্তু তাগুত মানুষকে আল্লার দাসত্ব করতে বাধা দেয় এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার আনুগত্য করতে বাধ্য করে। ফিরাউন এমনি ধরনের তাগুত ছিল বলেই মূসা (আ) কে ফিরাউনের নিকট পাঠাবার সময় আল্লাহ বললেন—

****************************************

 “ফিরাউনের কাছে যাও, নিশ্চয়ই সে বিদ্রোহ করেছে। ”-(সূরা আন নাযিয়াত: ১৭)

ইসলাম বিরোধী শক্তি এক কথায় তাগুত। দ্বীনে বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলা হয়যে, লা-ইলাহা বা কোন হুকুমকর্তাকে মানি না। অন্য সব কর্তাকে অস্বীকার করার পরই ইল্লাল্লাহ বলে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে স্বীকার করা যায়। সুতারাং ইসলামের প্রথম কথাই বাতিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ কারণেই কালেমার দাওয়াত নিয়ে যে নবীই এসছেন তাগুত বা বাতিল তাকে স্বাভাবিকভাবেই দুশমন মনে করে নিয়েছে।

আল্লাহ পাক যাদেরকে নবী ও রাসূল হিসেবে বাছাই করেছেন তারা সবাই নিজ নিজ দেশে সৎ, বিশ্বাসী, সত্যবাদী ও অন্যান্য যাবতীয় মানবিক গুণের কারণে জনপ্রিয় ছিলেন। দ্বীনে হকের দাওয়াত দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত শেষ নবীও আল-আমীন ও আস-সাদেক বলে প্রশংসিত ছিলেন। কিন্তু ********************************** “আল্লার দাসত্ব কর ও তাগুতকে ত্যাগ কর। ”-(সূরা আন নাহল: ৩৬) বলে দাওয়াত দেয়ার পর নবীর সাথে তাগুতের সংঘর্ষ না হয়েই পারে না।

নবীর দাওয়াত শুনেই নমরূদ, ফিরাউন ও আবু জেহেলরা বুঝতে পারল যে, তারা দেশকে যে আইনে শাসন করছে ও সমাজকে যে নীতিতে চালাচ্ছে, তা বদলিয়ে নবী নতুন কোন ব্যবস্থা চালু করতে চান। ফিরাউন স্পষ্ট বললো: **************************** “আমি আশংকা করি যে, (মূসা) তোমাদের দ্বীনকে বদলিয়ে দেবে। ”-(সূরা মুমিন:২৬)

যারা দেশ শাসন করে তারা আইন-কানুন এমনভাবেই বানায় যাতে শাসক শ্রেণীর স্বর্থ ঠিক থাকে। জনগণকে শোষণ করে শাষক গোষ্ঠীর প্রাধান্য বজায় রাখার উপযোগী আইন ও অর্থব্যবস্থাই চালূ রাখা হয়। মানব রচিত আইনের বৈশিষ্ট্যই এটা, সুতারাং প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল রাখাই শাসকদের স্বার্থ। এজন্যেই এদেরকে কায়েমী ম্বার্থ বলা হয়। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থা বহাল থাকলে যাদের স্বার্থ কায়েম থাকে তারাই কায়েমী স্বার্থ(Vested Interest)।

যখনই কোন নবী আল্লার দামত্বের দাওয়াত দিয়েছেন তখনই এ কায়েমী স্বার্থ এটাকে তাদের স্বার্থের বিরোধী বলে বুঝতে পেরেছে। সে কারণেই তারা বাধা দেয়া জরুরী মনে করেছে। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিই নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বার্থও নবীদেরকে সহ্য করেনি। ইব্রাহীম (আ)-এ পিতা আযর ধমীয় নেতা ছিল। নমরূদের দরবারে তার রাজ-পুরোহিতের মর্যাদা ছিল। ধর্মের ব্যবসা নিয়ে নমরূদের অদীনে সুখেই ছিল। ইব্রাহীম (আ)-এর দাওয়াতে আযরের ধর্মীয় কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগল। শেষ নবী আশা করেছিলেন যে, ইয়াহুদী ও নাসারাদের ওলামা ও পীরেরা (কুরআনের ভাষায় আহবার ও রুহবান) হয়তো তাঁর দাওয়াত সহজেই কবুল করবে। কারণ আল্লাহ, আখেরাত, নবী, ওহী ইত্যাদির সাথে তারা আগেই পরিচিত। কিন্তু দেখা গেল যে, রাসূল (সঃ) এর সাথে যখন মক্কার রাজনৈতিক ও অথনৈতিক ও কায়েমী স্বার্থের সংঘর্ষ বাঁধল তখন ঐ আহবার ও রুহবারদের ধর্মীয় স্বার্থও তাদেরকে আবু জেহেলদের সাথেই সহযোগিতা করতে বাধ্য করল। এভাবেই হক ও বাতিলের সংঘর্ষ অবশ্যই অনিবার্য এবং হকের বিরুদ্ধে সকল প্রকার কায়েমী স্বার্থ একজোট হয়েই বিরোধিতা করে থাকে।


ে।

 কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, মুসলিম প্রধান দেশে মুসলিম শাসকদের সাথে ইসলামী আন্দোলনের এ ধরনের বিরোধ হবার কারণ কী? মুসলিম নামধারী হলেই সত্যিকার ইসলামপন্থী হয়ে যায় না। ইয়াযীদ মুসলিম শাসকই ছিল। কিন্তু ইসলামী আদর্শের ধারক ইমাম হুসাইন (রাঃ) কে ইয়াযীদ সহ্য করতে পারেনি। এ দেশে মুসলিম নামধারী নাস্তিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, কমিউনিষ্ট ও সোসালিষ্ট বহু নেতা ও দল আছে যারা ইসলামী আন্দোলনের চরম দুশমন।

আসল ব্যাপার হলো কায়েমী স্বার্থের সুবিধা ভোগ করছে তারা যখন বুঝতে পারে যে, ইসলামী আন্দোলন বিজয়ী হলে যে ধরনের আইন-কানুন ও সমাজ ব্যবস্থা চালু হবে তাতে তাদের বর্তমান প্রতিষ্ঠিত স্বার্থহবে তখনই তারা এ আন্দোলনের শক্র হয়ে যায়।

যে বাতিল শক্তি দ্বীনে হক কায়েমের পথে বাধা সৃষ্টি করে তা দু ধরনের হয়ে থাকে। প্রধান বাতিল শক্তি হলো সরকারী ক্ষমতাসীন শক্তি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তারা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। অনৈসলামী সমাজে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দলের নেতৃত্বে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা যে চালু হতে পারে না সে কথা তারা ভালভাবেই জানে। ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই তারা ইসলামী আন্দোলনের বিরোধী।

সমাজে ইসলামী আন্দোলনের বিরোধী আরও এক ধরনের শক্তি রয়েছে যারা সরাসরি বাতিল শক্তির মাধ্যে গণ্য হলেও হক ও বাতিলের সংঘর্ষে তারা হকের পক্ষে সক্রিয় হন না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারা বাতিলের সাথেই সহযোগিতা করেন। বাতিলের বিরুদ্ধে ময়দানে যারা সক্রিয় নয় তারা ঐ সংঘর্ষে শেষ পর্যন্তনিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। এমনকি দ্বীনের খাদেম হয়েও এ জাতীয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হন। ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করার হিম্মত যারা করেন না তারা এক পর্যায়ে বাতিলেরই সহায়ক প্রমাণিত হন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন