মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০২২

নবম দশম শ্রেনীর পদার্থ বিজ্ঞান (২য় অধ্যায় -গতি) সকল জ্ঞান ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

১. গতি কাকে বলে? / গতি কী?
উত্তর –  পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে সময়ের সাথে কোনো বস্তুর অবস্থান পরিবর্তনের ঘটনাই গতি। 

২. স্থিতি কাকে বলে? / স্থিতি কী? 
উঃ সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে যখন কোনো বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন না হয় তখন তাকে স্থিতি বলে। 

৩. প্রসঙ্গ কাঠামো কাকে বলে? / প্রসঙ্গ বিন্দু কাকে বলে? 
অথবা, প্রসঙ্গ কাঠামো কী? / প্রসঙ্গ বিন্দু কী? 

উত্তর –  যে বস্তু বা বিন্দুর সাপেক্ষে কোন বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন বিবেচনা করা হয় তাকে প্রসঙ্গ কাঠামো বা বিন্দু বলে। 

৪. সরলরৈখিক গতি কী?
উঃ কোনো কিছু যদি সরলরেখায় যায় তার গতিই সরলরৈখিক গতি। 

৫. ঘূর্ণন গতি কী?
উত্তর – কোনো কিছু যদি একটা নির্দিষ্ট বিন্দুর সমদূরত্বে থেকে ঘুরতে থাকে তাহলে সেটাকে বলে ঘূর্ণন গতি। 

৬. চলন গতি কী?
উঃ কোনো কিছু যদি এমনভাবে চলতে থাকে যেন বস্তুর সকল কণা একই সময়ে একই দিকে যেতে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে চলন গতি। 

৭. পর্যায়বৃত্ত গতি কী?
উঃ কোনো গতিশীল বস্তু যদি নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু দিয়ে একই দিকে একইভাবে
অতিক্রম করে তাহলে সেটাকে পর্যায়বৃত্ত গতি বলে। 

৮. সরল স্পন্দন গতি কী?
উত্তর –  পর্যায়বৃত্ত গতি সম্পন্ন কোনো বস্তু যদি পর্যায়কালের অর্ধেক সময় কোনো নির্দিষ্ট দিকে এবং বাকি অর্ধেক সময় একই পথে তার বিপরীত দিকে চলে তবে তার গতিকে সরল স্পন্দন গতি বলে। 

৯. দূরত্ব কাকে বলে? / দূরত্ব কী?
উঃ একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর সাপেক্ষে বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তনকে দূরত্ব বলে।  

১০. সরণ কাকে বলে?
উঃ একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর সাপেক্ষে নির্দিষ্ট দিকে বস্তুর অতিক্রান্ত দূরত্বকে সরণ বলে।
১১. দ্রুতি কী?
উঃ সময়ের সাথে দূরত্ব পরিবর্তনের হারকে দ্রুতি বলে। 

১২. বেগ কী?
উঃ সময়ের সাথে সরণের পরিবর্তনের হারকে বেগ বলে। 

১৩. তাৎক্ষণিক দ্রুতি কী?
উঃ কোনো গতিশীল বস্তুর একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের দ্রুতিকে তাৎক্ষণিক দ্রুতি বলে।   

১৪.তাৎক্ষণিক বেগ কী?
উঃ কোনো গতিশীল বস্তুর একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের বেগকে তাৎক্ষণিক বেগ বলে। 

১৫. সুষম দ্রুতি কী?
উঃ সময়ের সাথে সাথে যে দ্রুতির মান বা দিকের পরিবর্তন হয় না তাকে সুষম দ্রুতি বলে। 

১৬. সুষম বেগ কী?
উঃ সময়ের সাথে সাথে যে বেগের মান বা দিকের পরিবর্তন হয় না তাকে সুষম বেগ বলে।  

১৭.অসম দ্রুতি কী?
উঃ সময়ের সাথে সাথে যে দ্রুতির মান বা দিকের পরিবর্তন হয় তাকে অসম দ্রুতি বলে। 

১৮. অসম বেগ কী?
উঃ যদি কোনো বস্তু এমনভাবে চলতে থাকে যে  সময়ের সাথে সরণের মান বা দিকের অথবা উভয়েরই পরিবর্তন হয় তাকে সুষম বেগ বলে।  

১৯. রাশি কাকে বলে?
উঃ যা কিছুর পরিমাপ করা যায় তাকে রাশি বলে। 

২০. স্কেলার রাশি কী?
উঃ যে রাশিকে শুধু একটি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় তাকে স্কেলার রাশি বলে। 

২১. ভেক্টর রাশি কী?
উঃ যে রাশিকে পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশ করতে মান ও দিক উভয়ই বলে দিতে হয় তাকে ভেক্টর রাশি বলে। 

২২. পরম স্থিতি কী?
উঃ  প্রসঙ্গ বস্তু যদি প্রকৃতপক্ষে স্থির হয় এবং তার সাপেক্ষে যে বস্তু স্থিতিশীল তাকে পরম স্থিতি বলে। 

২৩. পরম গতি কী?
উঃ প্রসঙ্গ বস্তু যদি প্রকৃতপক্ষে স্থির হয় এবং তার সাপেক্ষে যে বস্তু গতিশীল তার গতিকে পরম গতি বলে। 

২৪. জড়তা কী?
উঃ কোনো বস্তুতে মোট পদার্থের পরিমাণকে জড়তা বলে। 

২৫. গতি জড়তা কী?
উঃ গতিশীল বস্তু চিরকাল গতিশীল থাকার প্রবণতাকে গতি জড়তা বলে।


২৬. স্থিতি জড়তা কী?
উঃ স্থির বস্তুর চিরকাল স্থির থাকার প্রবণতাকে স্থিতি জড়তা বলে। 

২৭. ত্বরণ কী?
উঃ সময়ের সাথে সাথে বেগের পরিবর্তনের হারকে ত্বরণ বলে। 

২৮. মন্দন কী?
উঃ সময়ের সাথে সাথে কোনো বস্তুর বেগ হ্রাসের হারকে মন্দন বলে। 

২৯. সুষম ত্বরণ কী?
উঃ  সময়ের সাথে সাথে বেগের পরিবর্তনের হার যদি একই থাকে অর্থাৎ যে ত্বরণ এর মান বা দিক পরিবর্তন হয় না তাকে সুষম ত্বরণ বলে। 

৩০.অসম ত্বরণ কী?
উঃ সময়ের সাথে সাথে বেগের পরিবর্তনের হার যদি একই না থাকে অর্থাৎ যে ত্বরণ এর মান বা দিক পরিবর্তন হয় তাকে অসম ত্বরণ বলে।


৩১. গড়বেগ কাকে বলে?
উঃ অসম বেগে চলা কোনো বস্তুর সরণকে সময় দিয়ে ভাগ করলে যা পাওয়া যায়, তাকে গড়বেগ  বলে। 

৩২. আবর্ত গতি কাকে বলে?
উঃ যখন কোনো বস্তু কোনো নির্দিষ্ট বিন্দু বা অক্ষ থেকে বস্তুকণাগুলোর দূরত্ব অপরিবর্তিত রেখে ঐ বিন্দু বা অক্ষকে কেন্দ্র
করে ঘোরে তখন সে বস্তুর গতিকে আবর্ত গতি বলে। 

৩৩. গতির সমিকরণ কাকে বলে?
উঃ সময়ের পরিবর্তনের সাপেক্ষে কোন বস্তুর গতি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিয়য় যেসকল সমিকরণ দ্বারা উপস্থাপন করা হয় তাদেরকে গতির সমীকরণ বলা হয়। 

৩৪. পড়ন্ত বস্তুর প্রথম সূত্র কী?
উঃ স্থির অবস্থান থেকে মুক্তভাবে পড়ন্ত সকল বস্তু সমান সমান সময়ে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে। 

৩৫. পড়ন্ত বস্তুর দ্বিতীয় সূত্র কী?
উঃ স্থির অবস্থান থেকে মুক্তভাবে পড়ন্ত কোন বস্তুর যেকোনো সময়ের প্রাপ্ত বেগ ঐ সময়ের সমানুপাতিক । 


৩৬. পড়ন্ত বস্তুর তৃতীয় সূত্র কী?
উঃ স্থির অবস্থান থেকে মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তুর যে কোনো সময়ের প্রাপ্ত সরণ ঐ সময়ের বর্গের সমানুপাতিক । 

৩৭. ঢাল বা স্লোপ কী?
উঃ ঢাল হচ্ছে এমন একটি রেখা যা কোন রাশির দিক এবং কৌণিক মান বর্ণনা করে ।



 

শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০

হালাম হারামের পহেলা বৈশাখ ও কিছু কথা-জাকির রুবেল

পহেলা বৈশাখ নিয়ে কিছু কথা
ফতোয়া বা আইন নয় জাস্ট নিজের মতামত
------------------------------------------------------------------
পহেলা বৈশাখ পালনে ইসলামে কোনো বাধা নেই! একজন মুসলিম বাংলাদেশী হিসেবে আমি বাংলা নববর্ষ পালনের পক্ষপাতি৷বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটি আনন্দ করে কাটাবএটাই সাভাবিক, এবং এতে ধর্মীয়কোনো বিধি নিষেধ আছে বলে আমি মনে করিনা৷তবে হ্যা নববর্ষ পালন করতে হবে অবশ্যই অবশ্যই।
ইসামের গন্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ থেকে, অর্থাৎ ইসলাম সরাসরি নিষেধ করে এমন কোনো কাজ করা যাবেনা৷নববর্ষের দিন পান্তা-ইলিশ
খাওয়া যেতে পারে,তাতে ইসলামে কোনো নিষেধ
নেই, কারন পান্তা-ইলিশ এগুলা জায়েজ খাবার, জায়েজ খাবার শুধু নববর্ষের দিনকেনো, বছরের যে কোনদিন যে কোনো সময় খেতে পারবে ইসলামে তাতে কোনো বাধা নেই৷

নববর্ষের দিন নতুন পোশাক পরা,ইসলামে এতেও কোনো বাধা নেই৷ কারন ইসলামের পোশাক পরা জায়েজ,তাই নববর্ষের দিন নতুন পোশাক পরা যাবেনা এমন কোনো নিয়ম ইসলামে নেই৷তবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হয় এমন কোনো কাজ বছরের অন্য কোনদিন যেমনকরা যাবেনা, তেমনি নববর্ষের দিনও করা যাবেনা৷ যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রা,তারপর বাঙালি সাজার নামে হিন্দুদের সাজে সজ্জিত হওয়া, কিংবা অশ্লীল গান-বাজনা করা, নারী পুরুষ এক
সাথে র্যালিতে বের হওয়া..ইত্যাদি ইত্যাদি৷
অনেকে না বুজে বলে থাকেন পয়লা বৈশাখ নববর্ষ পালন করা নাজায়েজ! তারা যৌক্তি হিসেবে বলেন এটা হিন্দুদের উত্সব! আমি তাদের বলব ইতিহাসটা একটু ভালো করে জানুন,বাংলা নববর্ষের সাথে হিন্দুদের কোনো সম্পর্ক নেই৷

বাংলা বছর প্রবর্তন করেন ভারত বর্ষের মুসলিম আমলের অন্যতম প্রভাবশালী শাসক সম্রাট আকবর৷তিনি সম্রাজ্য চালানো সহজ করার জন্যই এই নতুন বছর প্রবর্তন করেন৷বাংলা সন-টাকে নতুন সন বলেও উচিত নয় কারন এইটা হলো হিজরী সনের একটা সংস্করণ বা শাখা৷ সম্রাট আকবর হিজরী সনকে সামনে রেখে সেটা থেকেই নতুন করে একটা সন ঠিক করার জন্য ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে আদেশ দেন, এবং ফতেহউল্লাহ সিরাজি হিজরী থেকে বাংলার প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে একটা নতুন সন উদ্ভাবন করেন৷এবং পরবর্তিতে ১৯৬৬ সালে আরেক মুসলিম মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা সনকে অধুনিকায়ন করে যুগোপযোগী করেন৷ ইতিহাস থেকে স্পষ্ট যে বাংলা সনের সাথে বাংলা নববর্ষের সাথে হিন্দুদের কোনো সম্পর্ক নেই,বরং বাংলা নববর্ষ হলো একান্ত মুসলমানের তৈরী একটা নতুন সন, এবং যেইটার ধারাবাহিকতা হলো নবীজির হিজরী সন থেকে৷তাই  আমি বলব নববর্ষ
পালনে কোনো বাধা নেই,তবে সেটা পালনে কোনো কিছু যেন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক
না সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে৷
সংযুক্তি:
১.আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে হলুদ নাজায়েজ /হারাম হওয়া সত্তেও ইসলামপন্থী ভাইদের সেখানে হরদম যাতায়াত করতে দেখি। এও দেখি যে তার ছবি তুলে এফবিতে আফলোড দিতে। সেটা কি? 
২.যে কোন দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রাতে প্রায় দেখ ইসলামপন্থিদের ব্যানার পেস্টুন হাতে। তাই কি শোভাযাত্রা কি হারাম?  ঈদে মিলাদুন্নবি,শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকি, বিজয় দিবসের র্যালি কি শোাযাত্রা নয়?
৩.নববর্ষে কাওকে শুভেচ্ছা জানানো কি হারাম হবে?

সোমবার, ১৮ মে, ২০২০

শমসের গাজী||এক হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবী নায়ক ||ফেনীর ইতিহাস পর্ব(১) -সংগ্রহ ও সম্পাদনা জাকির রুবেল

শমসের গাজী এক হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবী নায়ক


দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়টাতে বিস্ময়করভাবে উত্থান ঘটে এক বিল্পবীর। যিনি সফলভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন মগ-পর্তুগীজ-হার্মাদ জলদস্যুদের। যে সময়টায় শাসকদের সাথে প্রজাদের সম্পর্ক ছিল খাজনা দেওয়া-নেওয়া আর অত্যাচারের, সেই সময়টাতে জমিদার হয়ে তিনি নিজ প্রজাদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপের সামন্ত প্রভু ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে! অত্যাচারী বিক্রমশালী ত্রিপুরা রাজকে কৃষক-জনসাধারণের সহায়তায় পরাজিত করে গঠন করেছিলেন নিজ রাজ্য। ফেনীর এক হতদরিদ্র ঘরের সন্তান থেকে বীরত্ব আর ‍রাজনৈতিক মেধায় অধিপতি হয়েছিলেন বিশাল এক ভূখণ্ডের। নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ও ত্রিপুরা রাজ্যের নানা জায়গার নামকরণ আর নানা কেচ্ছা-কাহিনীতে নানাভাবে জড়িয়ে আছে তার নাম। তিনি শমসের গাজী। অকুভোতয় বীরত্বের জন্য যাকে ডাকা হয় 'ভাটির বাঘ'!


ফেনীর চম্পকনগর ছিল শমসের গাজীর রাজধানী

ত্রিপুরা রাজবংশকে উচ্ছেদ করার পর শমসের গাজী আগরতলা থেকে উদয়পুরে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে তার শাসন পরিচালনা করতেন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলাধীন রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত চম্পকনগর গ্রাম থেকে।
ফেনীর  শুভপুর বাজার থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে  চম্পকনগর গ্রাম। এই চম্পকনগরেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দরবার হল, অস্ত্রাগার সহ তার বিশাল আবাসস্থল। এখানে  তার বাসস্থানের স্মৃতি চিহ্ন এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। কিছু ধ্বংসাবশেষ, যেমন প্রাসাদের নিরাপত্তার জন্য খনন করা গড়খাই (খন্দক),  রাজপ্রাসাদের মাঝখানে তৈরি এককুল্লা দীঘি, পাহাড় কেটে তৈরি সুড়ঙ্গ পথ ইত্যাদি টিকে আছে এখনো। তবে তার বাড়ি ও দিঘীর বড় অংশই রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলের সীমানায়।


শমসের গাজীর শৈশব

শমসের গাজীর জন্ম নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কারো মতে ১৭০৫ কিংবা ১৭০৬ সালে, আবার কারো মতে ১৭১২ সালে বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা গ্রামে। তার পিতা পীর মোহাম্মদ তৎকালীন ওমরাবাদ পরগনার একটি কাছারিতে খাজনা আদায় করতেন। তার মায়ের নাম কৈয়ারা বেগম। আর্থিক অনটনের কারণে ভাগ্য অন্বেষণে শমসের গাজীর পিতা চাকরি ছেড়ে বেদরাবাদ এলাকায় সস্ত্রীক চলে আসেন এবং এখানেও নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়লে স্থানীয় জমিদার নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন। সেই বাড়িতেই জন্ম শমসের গাজীর। শৈশবেই  পিতাকে হারানোর ফলে শমসের অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হন।
কথিত আছে, একদিন মায়ের বকুনি শুনে ফেনী নদীর তীরে বসে কান্না করার সময় সে পথ ধরে নিজামপুর থেকে ধনুঘাট হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন ও তার  স্ত্রী সোনা দেবী । তালুকদার সাহেবের সন্তান ছিল না বলেই হয়তো শমসের গাজীর প্রতি দুর্বল হয়ে তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে যান। তারপর থেকে জগন্নাথ সেনের স্নেহ-মমতায়ই বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের। বড় হওয়ার সাথে সাথে লাঠি, কুস্তি, তলোয়ার কিংবা তীর-ধনুক চালনা সব ক্ষেত্রেই শমসের পারদর্শীতা শমসের গাজীকে চারদিকে পরিচিতি এনে দেয়।


শমসের গাজীর উত্থান

তালুকদার জগন্নাথ সেনের ইন্তেকালের পর শমসের গাজী শুভপুর কাছারির খাজনা আদায় ও নানাবিধ কাজের তদারকি করতে থাকেন। সেই সময়ে মহুরী নদীর তীরে পানুয়াঘাট নামক একটি কেল্লা ছিল। ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলে এখনো সে ঘাটের নাম মানুষের মুখে মুখে ফেরে, বলা হয়-
দিঘির মধ্যে জগন্নাথ
পাড়ের মধ্যে বীরসিংহ
পানির মধ্যে কৈয়ারা
হাটের মধ্যে লেমুয়া
ঘাটের মধ্যে পানুয়া।
শমসের গাজীর শৌর্য-বীর্য তখন চারদিকে বিদিত। এই সময় জমিদার নাছির মোহাম্মদ তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে গাজীকে পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় শমসের গাজীর ‍উত্থানের গল্প।
দক্ষিণ বাংলার এ অঞ্চলটি তখন মগ, পর্তুগীজ, হার্মাদ জলদস্যুদের কাছে জিম্মি তো ছিলই, উপরন্তু পানুয়াঘাটেই প্রায় পাঁচ শতাধিক চোর ডাকাতের একটি শক্তিশালী দল এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
শমসের গাজী তখন ত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। পানুয়াঘাটের কেল্লা প্রধান হয়েই তিনি মগ, পর্তুগীজ এবং স্থানীয় দস্যুদের সাফল্যের সাথে বিতাড়ন করেন। এই সাফল্য তাকে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।



একটি ব্যর্থ প্রেম ও কাহিনী ও দুঃখজনক অধ্যায়

শমসের গাজীর উত্থানের পেছনে জমিদার নাছির মোহাম্মদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি শমসের গাজীকে খুবই স্নেহ করতেন। শমসের গাজীর পিতাকেও তিনিই আশ্রয় দিয়েছিলেন। পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ হিসেবে তিনিই শমসের গাজীকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শমসের গাজী নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়া বিবিকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে সব সমীকরণ উল্টে যায়।
নাছির মোহাম্মদ খুবই অপমান বোধ করেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে গাজীকে কেল্লা প্রধানের পদ থেকে বহিষ্কার করেন। সেই সাথে তাকে ধরে আনার জন্য সৈন্যও পাঠান।
শমসের গাজী এত সহজে হেরে যেতে রাজি ছিলেন না। তিনি ও তার চাচাত ভাই ছদু পালোয়ান জমিদারের সৈন্যদের পরাজিত করে সেখান থেকে সরে পড়েন ও পার্শ্ববর্তী বেদারাবাদ এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন।
এর কিছুদিনের মধ্যেই জমিদার নাছির মোহাম্মদ শমসের গাজীর চাচাত ভাই ছদু পালোয়ানের হাতে নিহত হন। যদিও শমসের গাজী এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেননি বলেই মনে করা হয়, তথাপি কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাছির মোহাম্মদের পুত্রদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এবং তাদের হত্যা করে নাছির মোহাম্মদের জমিদারী নিজের দখলে নেন। এ প্রসঙ্গে গাজীনামায় কবি বলেন,
অন্দরে আছিল যত ধন বস্ত্র দ্রব্য।
অনলে দহিল আর গাজী নিল সর্ব্ব।।
হাতি-ঘোড়া, তোষা জোড়া আর যত মাল।
গাজী ছাদু নিয়া গেল আপন মহাল।।
নাছির মোহাম্মদ ও তারপর তার পুত্ররাও নিহত হওয়ার পর তাদের অনুগত সৈনিকরা অধিকাংশই পালিয়ে যায় আর কিছু শমসের গাজীর পক্ষেও যোগ দেয়। তবে যার জন্য এত কিছু, নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়া বিবিকে তিনি পেয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মন্তব্য পরস্পরবিরোধী। তবে কুমিল্লা অঞ্চলের দৈয়া বিবির হাট আজো কালের স্বাক্ষী হয়ে জানান দিচ্ছে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাসের।


ত্রিপুরা বিজয়

শমসের গাজী সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার রাজনৈতিক মেধা ও দূরদৃষ্টি ছিল অসাধারন। তিনি জমিদারি দখল করে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেননি, বরং ত্রিপুরা রাজের সাথে সংঘর্ষ নিশ্চিত ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনি দ্রুতই প্রজাদের সাথে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি শুধু ক্ষমতা কিংবা লোক দেখানোর জন্য নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই মানুষের দুর্দশা দূর করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আর সে কারণেই জনগণও তার প্রতিদান দিতে ভোলেনি। শমসের গাজীর সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক ছিলেন তার কৃষক-প্রজাগণ!
যা-ই হোক, শমসের গাজী গোপনে রণ প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বিশাল ভবন নির্মাণ করে তার চারপাশে প্রায় ৫০ গজ প্রশস্ত পরিখা খনন করেন, নিয়োগ করেন সশস্ত্র প্রহরী।
কৃষ্ণ মাণিক্য  তখন ত্রিপুরার রাজা। নাছির চৌধুরীরর পতনের পরই তার অংশীদার রতন চৌধুরী ত্রিপুরার কৃষ্ণ মাণিক্যের কাছে  অভিযোগ করলে ত্রিপুরারাজ উজির জয়দেব ও সেনাপতি লুচি দর্পনারায়ণকে পাঠান শমসের গাজীকে পরাস্ত করতে। শমসের গাজী প্রমাদ গুনলেন, যদিও তিনি গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যুদ্ধের জন্য, কিন্তু তা ছিল কেবল শুরু। উজির জয়দেব ও সেনাপতি দর্পনারায়ণ তিন হাজার সৈন্যসমেত ছাগলনাইয়া কেল্লায় উপস্থিত হলে শমসের গাজী সুকৌশলে উজির জয়দেবকে নিজ কব্জায় নিয়ে আসেন। উজিরের বন্দী হওয়ার খবর শুনে সেনাপতি দর্পনারায়ণ সৈন্যসমেত পালিয়ে যান।
শমসের গাজী উজিরকে কার্যত বন্দী করলেও তাকে মেহমানদারী করে নিজের বশে আনেন আর দক্ষ রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে উজিরের মুক্তির বিনিময়ে ত্রিপুরারাজের কাছ থেকে দক্ষিণ শিকের জমিদারিও লিখে নেন। জমিদারী লিখে নেওয়ার পর শমসের গাজী থেমে যাননি। তিনি একদিকে ত্রিপুরারাজের সাথে সখ্যতা বজায় রাখছিলেন, অপরদিকে নিজেও প্রস্তুতি নিচ্ছিলিন নিজের মতো করে।
জমিদার কিংবা শাসক হিসেবে শমসের গাজী প্রজাদরদী শাসক ছিলেন। কৃষক-শ্রমিকদের তিনি ভালোবাসতেন এবং জমিদার হয়েও তাদেরকে ভুলে যাননি কিংবা দূরে সরিয়ে দেননি।
জমিদারির প্রথম দিকেই পাহাড়ি ঢালে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় তিনি কৃষকদের খাজনা মওকুফ করে দেন। যদিও তার জমিদারীর প্রথম তিন বছরে দশ হাজার মুদ্রা খাজনা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি কানাকড়িও তিনি ত্রিপুরারাজকে প্রদান করেননি।
খাজনা না দেওয়াকে কেন্দ্র করে শমসের গাজী ও ত্রিপুরার রাজার মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। আর শমসের গাজীও যুদ্ধের জন্যই এতদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ত্রিপুরার রাজদরবার তখন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রীতিমতো দুর্বল। শমসের গাজীও ঠিক এই সময়টিই বেছে নেন যুদ্ধের জন্য।

ত্রিপুরারাজ শমসের গাজীকে শায়েস্তা করতে সেনাবাহিনী পাঠান। ত্রিপুরা রাজার সৈন্যরা খণ্ডলের কিল্লা এলাকায় অবস্থান নিয়ে লুটতরাজে লিপ্ত হয়। গ্রামবাসী ও কৃষকরাও ত্রিপুরা রাজার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তারা রাজার সৈন্যদের কাছে খাদ্যশস্য বিক্রয় বন্ধ করে দেয়। ফলে ত্রিপুরা রাজার সৈন্য শিবিরে শুরু হয় খাদ্য সংকট। শমসের গাজী ও তার চাচাতো ভাই ছাদু পালোয়ান এই সময় চালান প্রাণপণ আক্রমণ। তুমুল আক্রমনে ত্রিপুরা রাজের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দেয়।
শমসের গাজী ও ছাদু পালোয়ান রাজার সৈন্যদের তাড়া করে রাজধানী পর্যন্ত নিয়ে যান। এ বিষয়ে আজো কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে কাউকে শাসাতে প্রবাদ হিসেবে বলা হয়, “এক্কেরে দোম্বাই উদেপুর নিমোগোই!” অর্থাৎ “দৌড়িয়ে উদয়পুর নিয়ে যাব!”
এ প্রসঙ্গে গাজীনামায় মনোহর শেখ বলেন,
সামান্য গাজীর সনে না জিনিল রণে।
হেন অপমান বল সহিবে কেমনে।।
রাজারে তাড়ায়ে যায় রাজধানী তক।
এহতে লজ্জা কিবা আছে সমধিক।।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় তিন সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয়। ত্রিপুরা রাজার সহায়তায় মনিপুরি সৈন্যরা এগিয়ে আসলেও শমসের গাজীর বীরত্বের কাছে কেউই টিকতে পারেনি।  ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য আগরতলা ছেড়ে মনিপুরের দিকে পলায়ন করেন। আগরতলা থেকে সিলেটের মনু নদী পর্যন্ত শমসের গাজীর সীমানা বিস্তৃত হয়।


শুধু বিজয়ী নন, ছিলেন কৌশলীও

শমসের গাজীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। তিনি শুধু তরবারির জোরে রাজ্য শাসন করতে চাননি। ত্রিপুরা জয়ের পর তিনি অনুমান করেছিলেন, ত্রিপুরাবাসী তাকে বহিরাগত হিসেবে চিন্তা করতে পারে। তাই তিনি নিজে সিংহাসনে বসা থেকে বিরত থাকেন। তারচেয়ে বরং লক্ষণ মানিক্য নামক রাজপরিবারের এক সদস্যকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি অন্তরালে থেকে সব নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল গ্রহন করেন।
প্রথমদিকে যদিও কৃষ্ণমাণিক্য অর্থের বিনিময়ে ত্রিপুরার কুকি আদিবাসীদের শমসেরের বিরুদ্ধে লড়তে রসদ যোগান, কিন্তু প্রতিবারই কুকিরা শমসের গাজীর নিকট পরাজিত হয়। শমসের গাজী নিজ প্রজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কুকিদের বুঝিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে সফল হন। কুকিরা গাজীর উদার মনোভাব, প্রজাদের প্রতি দরদ ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কারণে গাজীকে রাজা হিসেবে মেনে নেয়। শুধু কুকিরা নয়, ত্রিপুরারাজের বহু অমাত্য, যেমন- উজির রামধন, উত্তর সিংহ, সেনাপতি রণ মর্দ্দন নারায়ণসহ অনেকে গাজীর বশ্যতা শিকার করেন ও তার পক্ষে নানা দায়িত্ব পালন করেন।

সাফল্যের অন্যতম নায়ক সাদুল্লাহ বা ছাদু পালোয়ানের সাথে বিবাদ

শমসের গাজীর সাফল্যের প্রধানতম সহযোগী ও ছোটবেলা থেকে সুখ-দুঃখের আজন্ম সাথী ছিলেন ছাদু পালোয়ান। কোনো কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। নিজ ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করে শমসের কৌশলে ছাদু পালোয়ানকে হত্যা করেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী বন্ধু হারিয়ে তিনি নিজেও শক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়েন, যা তার জন্য মোটেই সুখকর হয়নি।

শমসের গাজীর মৃত্যু, একটি নক্ষত্রের পতন

এ বিষয়ে সকলেই একমত যে শমসের গাজী স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেনননি, তবে ঠিক কীভাবে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
অনেকে মনে করেন, পলাশীর যুদ্ধের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইংরেজদের রোষানলের শিকার হন তিনি। ইংরেজরা প্রথমত তাকে দস্যু হিসেবে অপপ্রচার চালায়, অতঃপর ত্রিপুরারাজের সহায়তায় সুদক্ষ ইংরেজ বাহিনী প্রেরণ করে তাকে বন্দী ও  হত্যা করে। এই হিসেবে ১৭৬০ বা ১৭৬১ সালে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়। রাজমালা এবং ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফর কিংবা মীর কাশেমের শাসনকালে এবং তাদের নির্দেশেই শমসের গাজী নিহত হন।
তবে এই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। গাজীনামা বিবরণ অনুযায়ী, শমসের নিজামপুর পরগনার জমিদার আগা বাকেরের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আগা বাকের নবাব সিরাজের আস্থাভাজন ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবার থেকে আমন্ত্রণ এলে শমসের গাজী নবাব সিরাজের সাথে দেখা করে আসার পথে আগা বাকেরের পুত্র আগা সাদেকের বাহিনী কর্তৃক বন্দী হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। গাজীনামার লেখক মনোহর শেখের বিবরণ অনুযায়ী-
এগারশ উনষাইট সন জৈষ্ঠ্য মাসে।
জুম্মাবারে জান তুমি জোহরের শেষে।।
উনত্রিশ তারিখ সেই ছিল শুক্রবার ।
চলিল পশ্চিম মুখে গাজি মরিবার।।
কাজী মোজাম্মেল হকের লেখা তিন হাজার বছরের নোয়াখালী গ্রন্থেও আগা বাকের ও জসারত খাঁর ঘড়যন্ত্রে শমসের গাজী মুর্শিদাবাদ হইতে রংপুরের ঘোড়াঘাটে নীত হয়েছিলেন এবং সেখানেই তাকে হত্যা করা হয় বলে মত দেন। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে যদিও সব ঐতিহাসিক এখনো একমত নন। তবে আগা বাকেরকে শমসের গাজীর হত্যাকারী ধরে নিলে আগা বাকেরের শাসনকাল ও গাজীনামায় উল্লিখিত ঘটনার বিবরণ অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে ১৭৫২ থেকে ১৭৫৪ সালের মধ্যেই শমসের গাজী নিহত হয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ ১৭৫৪ সালেই মির্জা আলী নকীর আক্রমণে আগা বাকের নিহত হন ও আগা সাদেক পালিয়ে যান। আহমদ মমতাজের লেখা শমসের গাজী গ্রন্থেও ১৭৫৩ সালেই শমসের গাজী মৃত্যুবরণ করেন বলে মত পাওয়া যায়।


শমসের গাজীকে নিয়ে সমালোচনা

ঐতিহাসিকগণ নানাভাবে তার চরিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন। কারো মতে, তিনি ন্যায়পরায়ণ, দূরদর্শী, প্রজাদরদী শাসক, আবার কারো চোখে ডাকাত, অর্থলোলুপ এবং অকৃতজ্ঞ একজন মানুষ। কেউ কেউ আবার ডাকাত হিসেবে দেখলেও তার মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য তাকে দেখেন রবিনহুডের মতো মহান ব্যক্তি হিসেবে। তবে অনেক ঐতিহাসিক তার বিরুদ্ধে আনা অধিকাংশ অভিযোগগুলোকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন।
কথিত আছে, পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে এই এলাকার চোর–ডাকাতের দলটি প্রমাদ গোনে। তারা একত্র হয়ে শমসের গাজীর কাছে এই মর্মে আপোষ প্রস্তাব নিয়ে আসে যে, শমসের গাজীর সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। এখন থেকে তারা পানুয়াঘাট এলাকায় আর কোনো ডাকাতি করবেই না, বরং বাইরের এলাকা থেকে যে ডাকাতি করবে, তারও অর্ধেক গাজীকে দিতে রাজি হয়। এছাড়াও সবসময় গাজীর পাশে থাকবে বলে অঙ্গীকার করে।
সমালোচকগণ অভিযোগ করেন, শমসের গাজী ডাকাতদের সাথে সন্ধি করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করতেন এবং এছাড়াও বিভিন্ন সময় পাশ্ববর্তী জমিদারদের উপর আক্রমণ পরিচালনা, লুন্ঠন ও তার অাশ্রয়দাতা নাছির মোহাম্মদকে হত্যার অভিযোগ আনেন।
পৃথিবীতে কোনো শাসকই বিতর্কের উর্ধ্বে ছিলেন না। তাই শমসের গাজী শতভাগ নিষ্কলুষ ছিলেন, তা দাবি করা বাহুল্য মাত্র। শমসের গাজীও হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চতুরতা, শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, প্রয়োজনে পাশ্ববর্তী জমিদারদের সম্পদে হানা দিয়েছেন। তবে শমসের গাজীকে যে বিষয়গুলোতে অভিযোগ করা হয় তা যদি সমকালীন ইতিহাসের মানদণ্ডে বিচার করা হয়, তবে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিতে হয়। কারণ রাজনীতি ও রণকৌশলে নৈতিকতার চর্চা সমকালীন শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে বিরল।

শমসের গাজীর কৃতিত্ব

শমশের গাজী সামান্য সময় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু সে সময়টাই ইতিহাসে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। শমসের গাজী রণকৌশলের দিক থেকে, সাহসের দিক থেকে কিংবা সুশাসনের দিক থেকে পর্যালোচনা করলে তাকে একজন মহৎ শাসক ছাড়া অন্য কোনো অভিধা বেমানান। এমনকি শমসের গাজীর কট্টর সমালোচক 'রাজমালা'র লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহও গাজীর অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রজাদরদী চরিত্রের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি কৃষক-প্রজার সম্মিলিত শক্তির সহায়তায় রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণ করে কৃষক-শ্রমিকদের ভুলে যাননি। তার শাসনামলে প্রজাদের ভালো-মন্দের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন সর্বাধিক। তখনকার সময়ে কৃষকদের খাজনা মওকুফ করে দিয়ে সামন্ত রাজার বিপক্ষে লড়ার হিম্মত আর কোনো শাসক, জমিদার, নবাবরা দেখাতে পেরেছিলেন কি? এখানেই শমসের গাজী অন্যদের থেকে আলাদা।
মাত্র এক দশক সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে তিনি যে প্রজাহিতকর কাজ সম্পন্ন করেছেন, তার উদাহরণ সমসাময়িক ইতিহাসে জুড়ি মেলা ভার। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি ফেনী নদীতে বাঁধ নির্মান করেছিলেন, যা আদতেই একটি ঐতিহাসিক চিন্তা। ফেনী নদীর দক্ষিণ শিক (বর্তমান ছাগলনাইয়া) ও নিজামপুরে ফেনী নদীর দুটি অস্বাভাবিক বাঁক ছিল, যার জন্য প্রত্যেক বছর বন্যা হত। শমসের গাজী খাল কেটে বাঁকা নদীকে সোজা করেন, যা আজও কাটা গঙ্গা ও মরা গঙ্গা নামে পরিচিত।
প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে ছাগলনাইয়ায় তার মায়ের নামে খনন করা কৈয়ারা দীঘি আজো কালের স্বাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। তাছাড়া একখুইল্লা দীঘি, বুড়া সামন্তের দীঘি, তার মেয়ের নামে তনু বিবির দীঘি, বল্লভপুরের আলীয়া গাজীর দীঘি, পূর্ব ছাগলনাইয়ার দেয়ান আব্দুর রাজ্জাকের দীঘি সহ অসংখ্য দীঘি খনন করেছিলেন।

হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দরিদ্র ধর্মপ্রচারকদের তিনি অর্থ, নিষ্কর জমি প্রদান করেছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট, মসজিদ-মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও জগন্নাথ মন্দির আজও তার স্মৃতি বহন করে চলছে।
জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে বিভিন্ন জায়গায় তিনি অসংখ্য সড়ক নির্মান করেছিলেন, যা এখনো ত্রিপুরা ও নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলে গাজীর আইল নামে পরিচিত। নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তিনি নির্মাণ করেছিলেন দুর্গ ও সেনানিবাস।
পণ্যদ্রব্যের ওজন ও মূল্য নির্ধারণের মতো জনহিতকর সিন্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বিনামূল্যে ছাত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার মতো উদ্যোগ সেই সময়টাতে শমসের গাজী নিয়েছিলেন, যখন জমিদার কিংবা ভূস্বামীরা কৃষকদের উপর কীভাবে খাজনা আরো বাড়ানো যায়, সে চিন্তায় মশগুল ছিলেন।
দক্ষিণ শিক (ছাগলনাইয়া), আরামরাবাদ-ফেনী, খণ্ডল, জগৎপুর, সীতাকুন্ড-চট্টগ্রাম, তিষ্ণা-চৌদ্দগ্রাম, খাঞ্জানগর, বাগাসাইর, পার্টিকরা, নূরনগর, গঙ্গামণ্ডল, সরাইল-কুমিল্লা, বিসালগড়-সিলেট,  কুমিল্লা , জাহাননগর, মেহেরকুল,  বলদাখাল, কসবা, অষ্টজঙ্গল, চাকলা-রৌশনাবাদ, ভুলুয়া (নোয়াখালী) নিজামপুর পরগণা সহ বিশাল অঞ্চল অল্প সময়ে তার শাসনাধীন হয়েছিল।
তার শাসনাধীন অঞ্চলে তিনি যে সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তা একজন শমসের গাজীকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাই তো 'গাজীনামা'য় শেখ মনোহরের পুঁথির লাইনের মতো বলতে হয়-
“এখানে আসিয়া কবি শেখ মনোহর ভনে
শমসের গাজী ভাটির বাঘ জানুক জনে।”

তথ্যসূত্র: 

১. শমশের গাজী- আহমদ মমতাজ, প্রকাশক- বাংলা একাডেমি (২০১৩)
২. গাজীনামা- মনোহর শেখ
৩. রাজমালা- ভূপেন্দ্রচন্দ্র  চক্রবর্তী
৪. রাজমালা- কৈলাসচন্দ্র সিংহ
৫. The Land of Fourteen Gods: Ethno-cultural Profile of Tripura- Banikantha Bhattacharyya


বঙ্গবীর শমসের গাজীসমশের গাজী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক।[১] ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন তিনি ভাটির বাঘ বলে পরিচিত। শমসের গাজী নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন।

জন্ম

বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা। আঠার শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় এক বিপ্লবীর অভ্যুদয় ঘটে। তাঁর নাম শমসের গাজী। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ তাঁর উপাধি। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে দিলেন জ্ঞানপ্রদীপ। জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে অসফল প্রেম তাঁর জীবনকে উন্নীত করে ভিন্ন মাত্রায়। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। [২]
বঙ্গবীর শমসের গাজী বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল পীর মুহাম্মদ মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান এবং মাতার নাম ছিল কৈয়্যারা বিবি। [৩] তিনি প্রথম জীবনে এক জমিদারের ক্রীতদাস ছিলেন।[১]

শৈশব

ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড ধরে ৭ কিলোমিটার চট্টগ্রামের দিকে গেলেই সামনে পড়ে কৈয়ারা বাজার। এখানে গ্রামটির নামও কৈয়ারা। এই কৈয়ারা গ্রামটি কৈয়ারা বিবির নামানুসারে রাখা হয়েছে। আর কৈয়ারা বিবি হচ্ছেন শমসের গাজীর মা। শমসের গাজীকে বলা হয় ভাটির বাঘ। তার বাবার নাম পীর মোহাম্মদ। পীর মোহাম্মদ একজন খাজনা আদায়কারী ছিলেন। কোনো এক কারণে তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বেদরাবাদ এলাকায় চলে আসেন। আর্থিক কষ্টে তিনি যখন দিশেহারা তখন নিজকুঞ্জরা মৌজার দানশীল ব্যক্তি নাসির মন চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন। সেই বাড়িতেই শমসের গাজী ভূমিষ্ট হন। শমসের গাজীর বাল্যকাল ছিল বৈচিত্র্যময়। অতি অল্প বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। অভাবের সংসার সত্ত্বেও বালক শমসের ছিলেন খুবই দুরন্ত স্বভাবের। একদিন মায়ের বকুনি খেয়ে তিনি ফেনী নদীর তীরে বসে কাঁদছিলেন। তখন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন শমসেরকে দেখতে পান। দয়াপরবশ হয়ে তিনি শমসেরকে শুভপুর নিয়ে যান। শুভপুরের তালুকদারের কোনো সন্তান ছিল না। সেখানে স্নেহ-মমতার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের গাজী। লেখাপড়ার পাশাপাশি কুস্তি, লাঠিখেলা, তীর-ধনুক চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে তালিম নিতে থাকেন।

জমিদারি লাভ

তালুকদার জগন্নাথ সেনের মৃত্যুর পর যুবক শমসের গাজী শুভপুরের খাজনা আদায় শুরু করেন। শুরু হয় তার উত্থান। সে সময় তিনি চোর ডাকাত ও জলদস্যুদের রুখতে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। গাজীর এই বাহিনীর সেনাপতি ছিল তার জ্ঞাতি ভাই ছাদু পালোয়ান। ১৭৩৯ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজের সেনাপতি শমসের গাজীর এলাকায় প্রবেশ করলে সেনাপতি ছাদু পালোয়ানের প্রতিরোধে তারা ধরাশায়ী এবং বন্দি হন। ত্রিপুরার মহারাজ তার সেনাপতির মুক্তির শর্তে গাজী কেদক্ষিণশিকের বৈধ জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। শমসের গাজী ছিলেন প্রজাদরদি। পাহাড়িয়া ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে তিনি কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন এবং পরবর্তী তিন বছর মহারাজের রাজকোষে খাজনা দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। এতে ত্রিপুরা মহারাজ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ৭ হাজার সৈন্য পাঠায় গাজীকে উচ্ছেদ করার জন্য। ফল হয় বিপরীত। শোচনীয় পরাজয়ে প্রাসাদ ছেড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের বিরাট অংশ শমসের গাজীর করতলে এসে যায়। শমসের গাজীর রাজত্বকালে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরেই ছিল। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে ফেনী নদীবেষ্টিত জগন্নাথ-সোনাপুরস্থ চম্পকনগরে তার প্রধান কেল্লা ও রাজপ্রাসাদে থাকতেন।

স্মৃতি ও কীর্তির নিদর্শন

কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকান্ডের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুররাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। ভুখানাঙা চাষাভুষাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে। হীরকডানায় ভর করে যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ান তেজোদীপ্ত যবন বীর শমসের। শত্রুসেনা বিনাশ করতে করতে হয়ে ওঠেন অবিনাশী যোদ্ধা, অপ্রতিরোধ্য হন্তারক। অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন টানা এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা।
ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে ভারতের সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজীর দীঘি এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে রয়ে গেছে।[৪]

নির্মমভাবে হত্যা

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। বাংলার এমন দুর্যোগ মুহূর্তে স্থানীয় কুচক্রী মহল, ঢাকার নবাবের প্রতিনিধি, ইংরেজ বেনিয়া ও পরাজিত, বিতাড়িত ত্রিপুরার মহারাজ একত্রিত হয় শমসের গাজীর বিরুদ্ধে। শমসের গাজীর দেশপ্রেম ও সাহসিকতা ইংরেজ এবং এ দেশীয় দালাল কুচক্রীদের ভীত করে তুলেছিল। নবাবের নামে মূলত ইংরেজরাই ষড়যন্ত্র করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী এবং যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের নেতৃত্বে পাহাড়ী উপজাতীয় যৌথবাহিনী শমসের গাজীর কেল্লা ও উদয়পুরে আক্রমণ চালিয়ে গাজীকে পরাজিত ও আটক করে। তাদের এতটাই আক্রোশ ছিল যে, ত্রিপুরার মহারাজ হাতিসহ হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে চম্পকনগরস্থ শমসের গাজীর প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।
শুরু হয় আরেক লড়াই। চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। একদিকে তিনি অকুতোভয় বীর, প্রজাদরদি রাজা, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে মনকাড়া বাঁশিওয়ালা। গভীর রাতে বাঁশির সুর শুনে বেরিয়ে আসেন আত্মগোপন থেকে। অমীমাংসিত থেকে যায় তাঁর মৃত্যু।


শমসের গাজীর কেল্লা ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার চম্পকনগর ও জগন্নাথ সোনাপুরএ অবস্থিত।[১] বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। শমসের গাজী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক।[২] ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন তিনি ভাটির বাঘ বলে পরিচিত। শমসের গাজী নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন।

অবস্থান

ফেনীর ছাগলনাইয়ার চম্পকনগর ও জগন্নাথ সোনাপুরের বর্তমান ভারত সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজীর দীঘি এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে রয়ে গেছে।

বর্তমান অবস্থায়

শমসের গাজীর তৈরি দুর্গটি এখন বিলুপ্ত। কিন্তু সেখানে তার স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছুই রয়ে গেছে। তার তৈরি কৈয়্যারা দিঘী,গুপ্ত সুড়ঙ্গ ইত্যাদি রয়ে গেছে। কিছু কিছু স্থাপত্য এখন পাশে ভারতের সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরা রাজ্যে রয়ে গেছে। বর্মানে তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে সেখানে শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্টস নামক পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। অনেক পর্যটকই সেখানে ভ্রমন করেন।

শমসের গাজী  আঠারো শতকের ৪০ এর দশকের প্রথম দিকে ‘ভাটির বাঘ’ নামে খ্যাত। তিনি নোয়াখালীর এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দক্ষিণ কুমিল্লা ও উত্তর নোয়াখালী জুড়ে বিস্তৃত চাকলা রওশনাবাদের অধিপতি হয়েছিলেন। ক্রমে তিনি সমগ্র কুমিল্লা জেলাই দখল করেন। তিনি নিজামপুর পরগনা জয় করে মেঘনা, মুহরী ও মনুগঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চলের মুকুটহীন রাজা হন। তিনি শৈশব থেকে সাহসী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তখন চাকলা রওশনাবাদ ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন। জমিদার ছিলেন নাসির মাহমুদ। জমিদার যত্ন করে শমসেরকে লালন-পালন করেন। যুবক শমসের অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে জমিদার-তালুকদারের জোর-জুলুম ও লুণ্ঠনে প্রজাগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শমসের গাজী সমগ্র অঞ্চল দখল করে শাসন শুরু করেন। দরিদ্র কৃষকের কর তিনি মওকুফ করেন। তাঁর অর্থনৈতিক সুব্যবস্থার জন্য জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়। তিনি বহু হিন্দু-মুসলমানকে লাখেরাজ ভূমি দিয়েছিলেন। তিনি রাজধানী জগন্নাথ সোনাপুর ও রাজধানীর বাইরে বহু দিঘি খনন ও বিদ্যালয় নির্মাণ করেছিলেন। দিঘিগুলির মধ্যে ‘কৈয়ার সাগর’ ছিল বৃহত্তম।
ত্রিপুরাধিপতি কৃষ্ণমাণিক্য তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ কুকী বাহিনীর দুটি শক্তিশালী অভিযান পাঠিয়েছিলেন। শমসের গাজীর অসাধারণ সমর-কৌশল ও শৌর্যবীর্যের দরুন দুটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। গাজী ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর দখল করেন। রাজা আগরতলায় পলায়ন করেন এবং বাংলার নওয়াব মীরকাসিমের শরণাপন্ন হন। নওয়াবের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলে যড়যন্ত্র করে শমসের গাজীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয় (১৭৬০)। কৃষ্ণমাণিক্য তাঁর হূতরাজ্য পুনর্দখল করেন


ফেনী জেলার ছাগলনইয়া একসময়ের ভাটির বীর শমসের গাজীর বাগান বাড়ির অবস্থান। একসময় এ অঞ্চলের একমাত্র পরাক্রমশালী শাসক ও স্থানীয় পরাশক্তি যোদ্ধাশাসক  শমসের গাজির বাড়ি। মূলত এ বাগান বাড়িতেই একসময় তার প্রাসাদ। । ৩৫০ বছর পূর্বের একজন শাসক কীভাবে তার সেনা দূর্গ ও রাজধানী প্রতিরক্ষার জন্য  আধুনিক রণকৌশল ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তার বহু নির্দর্শন মিলবে এখানে। সৌখিন বংশীবাদক শমেসের গাজী সমসাময়িক কালে বাংলার একমাত্র শাসক যিনি
ত্রিপুরা অধিকার করেছিলেন এবং ফেনীর চম্পক নগর থেকে পুরো রাজ্য পরিচালনা  করেছেন। তিনি রাজধানীতে না থেকে তার জন্ম ভিটায় থাকতে বেশী পছন্দ করতেন।  এখানে তার একটি কেল্লাও ছিলো।
বীর ‬শমসের গাজী তার মাতার নামে এ দীঘি খনন করলেও এটা এখন শমসের গাজীর দিঘী হিসেবে পরিচিত। এ দীঘি ছাগলনাইয়া উপজেলা সদরের নিকটবর্তী ভারতীয় সীমান্তের কাছে সোনাপুর গ্রামে অবস্থিত। ৪.৩৬ একর আয়তনের এ দীঘি ১/৩ভাগ ভারতীয় অংশে পড়েছে।
এই দিঘীর পাড়ে রয়েছে শমেসের গাজীর সুড়ঙ্গ। এটি একসময় বন্ধ করে দেয়া হলেও। এর স্মৃতিচিহ্ন এখনো রয়েছে। কথিত আছে এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে রানীরা দিঘীতে গোসল করতে যেতেন। এছাড়া এই সুড়ঙ্গ নিয়ে নানারকম ও লোককথা রয়েছে। ব্রিটিশদের সহায়তায় ত্রিপুরার রাজা যখন শমসের গাজীর বসভিটা আক্রমণ করেন এবং তা গুড়িয়ে দেন। তখন তিনি এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করে থাকেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ গাজী ছিলেন একজন শিল্পরসিক ও প্রেমিক পুরুষ। তিনি বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন এবং বাঁশির সুর ভালোবাসতেন। ত্রিপুরা রাজা তাকে হত্যা করার জন্য গভীর রাতে একজন বংশীবাদক দিয়ে বাঁশির সূর তোলেন। পরে গোপনীয় স্থান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। এবং তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। একজন বীর যোদ্ধার জীবনাবসান এবং এই অঞ্ছলে ব্রিটিশ আধিপত্য একসাথে প্রতিষ্ঠিত হয়।

 ফেনীর ছাগলনাইয়া পরশুরাম এলাকাটি একটি উপত্যকার মত। এক সময় এ এলাকাকে বলা হত চাকলালা রৌশনাবাদ। এ চাকলালা রৌশনাবাদের পুর্ব পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা চোট বড় পাহাড় আর দক্ষিনে সাগর। মাজখানে চমৎকার সমভুমি। এর বুক চিরে বইচে মুহুরী, কহুয়া ও চিলুনিয়া নদী। বর্ষা কালে অতি বৃষ্টি হলে ত্রিপুরার পাহাড়ী ঢল নদীর দু’কুল ভেষে নিকটবর্তি নিচু জমি ও বাড়ী ঘর ভাষিয়ে গেলেও এর স্থায়ীত্ব থাকে ক্ষনস্থায়ী। বৃষ্টি থেমে গেলে পানী নেমে যায় বাকি সময় একেবারেই শান্ত। বিস্তির্ন ফষলী মাঠ নদীর কল কল ধ্বনী। পাখির কলতান।এ উপত্যকার জমিদার ছিলেন জমিদার নাছির মোহাম্মদ। আর জমিদারের তহসিলদার ছিলেন শমশের গাজী, সুদর্শন সুঠাম দেহী শমশের সহজেই জমিদার পরীবারের মন জয় করে নেন। এ সুবাদে তার অবাধ যাতায়াত ছিল জমিদার মহলে। প্রেমে পড়ে যান জমিদারের একমাত্র সুন্দরী কন্যা দৈয়া বিবির সাথে।
জমিদার কন্যার সাথে সামান্য তহসিলদারের প্রেম! অসম্ভব। রেগে অগ্নিশর্মা নাছির মোহাম্মদ। যেভাবেই হোক শমশেরের মস্তক চাই। শমশের এরুপ পরিস্থিতির জন্য আগেই প্রস্তুত ছিল। বেধেগেল যুদ্ধ। শমশেরের বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গোপনে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। সাহসী এবং ভীর শমশেরের নেত্রিত্বে লাঠিয়াল বাহিনী উল্কা বেগে আক্রমন করে বসল জমিদার বাড়ী। কার সাধ্য তাকে রোখে!। নাছির মোহাম্মদের সোচনীয় পরাজয়। কোন রকমে প্রান নিয়ে পালিয়ে গেলেন উদয়পুরে। সে থেকে ফেনীর লোক কাউকে ধমকাতে গিয়ে বলে (এক্কারে দোম্বই উধপুর নিমুগোই) একেবারে দোড়াই উদয়পুর নিয়ে যাব।
পালিয়ে যাওয়ার সময় নাছির মোহাম্মদ তার কন্যাকে সাথে নিতে চেয়ে ছিলেল কিন্তু দৈয়া বিবি আগেই শমশেরের শিবিরে চলে আসেন। কাজে মেয়েকে ফেলেই নাছির মোহাম্মদকে পালাতে হয়েছিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে। আশ্রয় নিয়ে ছিলেন উদয়পুরের জমিদার বাড়ীতে। শমশের দৈয়া বিবিকে পেলেন সাথে জমিদারিও। শমশেরের জমিদারী আমল ছিল ব্যতিক্রম ধর্মী। সাহসী বীর শমশের ভয় পেতেন না কাওকে বরং লোকে তাকে ভয় পেত। আশ পাশের অন্যান্য জমিদার গন, সুদ খোর মহাজন, মুনাফা খোর এবং জোরদারদের কাছে সে ছিল মুর্তমান আতংক। তাদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে সাধারনের মধ্যে বিলি করতেন অথবা জনসার্থে ব্যয় করতেন অকাতরে তাই জোরদারদের কাছে সে ছিল শমশের ডাকু আর স্বাধারনের কাছে গাজী। তার ভয়ে এবং আতংকে আশ পাশের জমিদারদের ঘুম হারাম হয়ে যায় শমশের কখন কার জমিদারী দখল করে নেয়। ভয়ের আরেকটি কারন হচ্ছে শমশেরের জনপ্রিয়তা।
নাছির মোহাম্মদ ও অন্যান্য কতিপয় জমিদার নবাবের দরবারে হাজির মুর্শিদাবাদে। জমিদারগন নবাবকে বুজাতে সক্ষম হন যে; শমশেরের গতি এখনি রোধ করা না গেলে সে আশেপাশের অন্যান্য জমিদারী দখল করে নিবে এবং নিজেকে স্বাধীন ঘোষনা করবে।
নবাব সৈন্য পাঠালেন, কৌশলে শমশের গাজীকে বন্ধিকরা হল এবং নির্মমভাবে হত্যা হল। তার ভুগভর্স্থ অশ্রাগার ধ্বংশ করা হল যা “শমশের গাজির এক্ষুল্যা” নামে ইতিহাসে সাক্ষি হয়ে আছে।
শমশের বেশ কিচু জনহিতকর কাজ করে গেছেন। সুপেয় পানির জন্য ফেনীর যায়গা যায়গায় বড় বড় দীঘী ক্ষনন করেছেন, চলাচলের জন্য রাস্তা, কেনা কাটার জন্য হাট বাজার।
শমশের গাজী দীঘি, কৈয়ারা দীঘি, দৈয়া বিবির রাস্তা, দৈয়া বিবির হাট তাকে অমর করে রেখেগেছ্। আজো নিশীথ রাতে হুহু হুহু করে বাতাস কাদে; গ্রামে আজ ও বিলাপ হয় “ঢাকা গিয়া শমশের গাজী কিনি খাইলো নুন, কৈয়ো কৈয়ো মায়ের কাছে গাজী হইলো খুন”।


 উপরন্তু খুব দ্রুত সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে তার বহি:শত্রুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি
পাচ্ছিল। সমসাময়িক অন্য জমিদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরির কোন উদ্যোগ তিনি গ্রহণ
করেননি। ফলে তিনি মিত্রহীন হয়ে পড়েন। এরই মাঝে তিনি নিজামপুর পরগণার জমিদার
আগা বাকের এর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। নবাব আলীবর্দী খাঁর রাজপরিবারেও তখন
নানা রকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল কারণ তাঁর বড় কন্যার জামাতা ছিলেন ঢাকার নায়েবে
নাজিম হোসাইন উদ্দিন খাঁ। তিনি ঢাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু কোন এসব অজ্ঞাত
কারণে হোসাইন উদ্দিন খাঁর প্রতি নবাব আলী বর্দী খাঁর নাতি সিরাজ উদ দৌলা অসন্তুষ্ট
ছিলেন। অন্যদিকে আগা সাদেক ছিলেন সিরাজের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং প্রিয়ভাজন। এমনিতর
একটি প্রেক্ষাপটে মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবার থেকে আমন্ত্রণ আসলে শমশের গাজী
সেখানে যেতে মনস্থির করলেন। তদুদ্দেশ্যে তিনি সোনাপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা
হন। মনোহর শেখের বক্তব্য অনুযায়ী তিনি জামাতা হোসাইন উদ্দিন খাঁর বাসস্থান হোসেনি
দালানে ৭দিন অবস্থান করেন। জামাতার নিষেধ সত্বেও তিনি মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে
রওনা হন। নবাবের সাথে সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পথে আগা সাদেকের বাহিনী কর্তৃক বন্দি
হন। বন্দি অবস্থাতেই বীর কেশরী শমশের গাজীকে হত্যা করা হয়। যবনিকাপাত ঘটল একটি
অধ্যায়ের। শমশের গাজীকে নিয়ে যে পরিমাণ বির্তক হয়েছে বা তার কর্মকা-ের মাঝে যে
পরিমাণ বৈপরিত্য রয়েছে তা সমসাময়িক সময়ে বাংলার আর কোন ব্যক্তিকে নিয়ে হয়নি।
তাকে কখনো মনে হয়েছে স¤্রাট আত্তরঙ্গজেবের মত ন্যায় পরায়ণ শাসক, আবার কখনও মনে
হয়েছে শেরউড জঙ্গলের রবিন হুডের মত ডাকাত, কখনও মনে হয়েছে চাণক্য বুদ্ধি সম্পন্ন
ব্যক্তি আবার কখনও মনে হয়েছে অবোধ শিশুর মত সহজ সরল। কখনও মনে হয়েছে চরম
উচ্চাভিলাষী আবার কখনও মনে হয়েছে পরিস্থিতির নায়ক, কখনও মনে হয়েছে অর্থ লিপ্সু,
আবার কখনও মনে হয়েছে প্রজাবৎসল মহান শাসক। শমশের গাজীকে নিয়ে সত্যিকার অর্থে
বৃহৎ আঙ্গিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে কোন প্রকার গবেষণা আজ অবধি হয়নি। বিছিন্নভাবে ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র কিছু কাজ হয়তো হয়েছে, যা একজন শমশের গাজীকে উপলব্ধি করার জন্য মোটেও
পর্যাপ্ত নয়। শমশের গাজীর জীবনের প্রতি পরতে পরতে রহস্য আর বিভ্রান্তি। তিনি স্বীয়
আশ্রয়দাতা নাছির মোহাম্মদের কন্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান, প্রস্তাব প্রত্যাখাত
হবার পর তার চাচাত ভাই এবং সহযোগী ছাদু পালোয়ান নাছির মোহাম্মদকে হত্যা করেন।
শমশের গাজীর জীবনীকার মনোহর শেখের মতে এতে শমশের বিক্ষুদ্ধ হন এবং ছাদু
পালোয়ানকে তিরস্কার করেন। আবার কিছুদিন পরেই ছাদু পালোয়ানকে সাথে নিয়ে নাছির
মোহাম্মদের সৈনিকদের সাথে যুদ্ধ করেন এবং নাছির মোহাম্মদের দুই পুত্রকে হত্যা করেন।
তাহলে মনোহর শেখের বর্ণনামতে ছাদুপালোয়ানের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হবার কথাটি ধোপে টিকে
না। শুধু তাই নয় পানুয়াঘাট দুর্গের প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ডাকাতদের সাথে
বন্ধুত্ব করেন। ডাকাতির সামগ্রীর অর্ধেক উপঢৌকন হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রভূত
সম্পদের মালিক হন। অভিযোগ আছে পরবর্তী জীবনেও শমশের গাজী ডাকাতির এই অভ্যাস
ত্যাগ করতে পারেননি। নিজ রাজ্যের বাইরে ধনী ব্যাক্তি কিংবা অন্য জমিদারদের অর্থ
সম্পদ লুট করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মৌলভি হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর রচিত
তাওয়ারিখ ই-হামিদ গ্রন্থে এবং মি. কামিন্স এর প্রতিবেদনে গাজীকে বড় লুন্ঠনকারী
(এৎবধঃ চষঁহফবৎবৎ) আখ্যা দেয়া হয়েছে। “রাজমালা” গ্রন্থে তাকে বারবার শমসের
ডাকাত হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। যে ছাদু পালোয়ান শিশুকাল থেকে শমশের গাজীর
সাথে ছায়ার মত মিশে ছিলেন, গাজীর প্রতিটি সাফল্যে যার অবদান অসামান্য সেই ছাদু
পালোয়ানকেও ক্ষমতার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে হত্যা করেন শমশের গাজী। নিজের
প্রয়োজনে অসংখ্যবার তিনি পার্শ¦বর্তী জমিদারদের পুকুরের মাছ লুন্ঠন করেন। এ সমস্ত
আচরণের কোনটাই একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ব্যাক্তির সাথে যায়না। আবার অসংখ্য জনহিতকর
কর্মকা- তাঁর দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। পানীয় জলের
সমস্যা সে আমলে জনসাধারনের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল। এ সমস্যা সমাধানে শমশের
গাজী অনেকগুলো দিঘি খনন করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৈয়ারা দিঘি, বুড়ো সা¤œী
দিঘি, নর্দমা দিঘি, রাঙ্গামাটি দিঘি, একখুইল্লার দিঘি, সাত কুচিয়া শমসের গাজীর
দিঘি, তনু বিবির দিঘি, মনু বিবির দিঘি, কাটা গাং, মরা গাং, ফটিকছড়ির শমশের
গাজী দিঘি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে কৈয়ারা দিঘি এবং সাত কুচিয়া শমসের গাজীর
দিঘি আয়তনের দিক থেকে কুমিল্লার ধর্মসাগরের চাইতেও বিশাল আবার একখুইল্লার দিঘিটি
বিস্ময়কর, এর চর্তুদিকে পাহাড় মাঝখানে অত্যন্ত গভীর । ১৯৪৭ সনে দেশভাগের সময় এই
জলাশয়ের অধিকাংশ অংশ ভারতের অন্তর্গত হয় আর কিছু অংশ বাংলাদেশের অংশে। ১৯৭১ এ
মহান মুক্তিযদ্ধের সময় ভারতে আশ্রিত শরণার্থীরা এ দিঘির পানি ব্যবহার করত। ত্রিপুরা
জয়ের পর রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে চন্দ্রপুর গ্রামে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যদিও
তা অযতœ-অবহেলার কারণে এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। অসম্প্রদায়িক শমশের গাজী
মসজিদের পাশাপাশি মেহেরকুলের (কুমিল্লা) একাধিক স্থানে কালিমন্দির নির্মাণ করেন।
কৈয়ারা দিঘি এবং বাজারের পাশে শমশের গাজী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঈদগাঁএ মুসলমানরা
এখনও দুই ঈদের নামাজ আদায় করে। চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রণেতা ওহীদুল আলমের মতে
চট্টগ্রামের উত্তর সীমানায় ফটিকছড়ি উপজেলায় চাড়ালিয়া হাটের নিকট শমশের গাজীর
দিঘি ও টিলা রয়েছে। তিনি জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার
প্রভূত উন্নয়ন করেন। জগন্নাথ সোনাপুর কেল্লাবাড়ী থেকে সোজা পশ্চিম দিকের সড়কটি
শমশের গাজী রোড নামে পরিচিত। সড়কটি ঢাকা চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়ক সংলগ্ন। শমশের
গাজী ত্রিপুরা রাজ্য জয় করে জনসাধারণের সুবিধার্থে সেখানে অনেকগুলো সড়ক নির্মাণ
করেন। সেগুলি গাজীর আইল নামে পরিচিত। কুমিল্লাতেও রয়েছে শমশের গাজীর স্মৃতি।
কুমিল্লা শহর থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে বিবির বাজার সংলগ্ন গোলাবাড়ী গ্রামে শমশের
গাজী একটি কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। কেল্লার ধ্বংসাবশেষ কিছুকাল আগেও বিদ্যমান
ছিল। গোলাবাড়ী থেকে যে সড়কটি উদয়পুরের দিকে গেছে তা স্থানীয়দের নিকট গাজীর
আইল নামে খ্যাত। কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের রাঙ্গামাটি গ্রামে তিনি আরেকটি কেল্লা
নির্মাণ করেছিলেন। চাকলা রোশনাবাদ এবং মেহেরকুল পরগণার বিভিন্ন স্থানের সুরক্ষার
জন্য তিনি আরো অনেকগুলো কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। কৈয়ারা দিঘি এবং বাজার সংলগ্ন
স্থানে শমশের গাজী স্থাপন করেন একটি সেনানিবাস। এই সেনানিবাসে দুই হাজার সৈন্য
অবস্থান করত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া গোমতি নদীর তীরে শমশের গাজী একটি
বিশাল দুর্গ নির্মাণ করেন এটি গাজীর কোট নামে পরিচিত। নিজামপুর পরগণায়ও
(বর্তমানে মীরেরসরাই) তিনি একটি কেল্লা তৈরি করেছিলেন। শমশের গাজী রাজ্য
বিস্তার এবং যুদ্ধবিগ্রহ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন একথা ভাবলে শমশের গাজীর প্রতি অন্যায়
করা হবে। তিনি শিক্ষা বিস্তার এবং ন্যায় পরায়ণতা এবং জনসাধারণকে ন্যায্য মূল্যে
দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজেও মনোনিবেশ করেন। ছাত্রদের শিক্ষাদানের
উদ্দেশ্যে শমশের গাজী নিজ অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বিদ্যালয়। যেখানে ১০০
ছাত্রের অধ্যয়ন, তাদের থাকা-খাওয়া, বস্ত্রসহ যাবতীয় সুব্যবস্থা ছিল। এটি ছিল একটি
আবাসিক বিদ্যালয়। যেখানে আরবি, ফারসি ভাষার সাথে মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাদান
করা হতো। প্রজাদের মঙ্গল সাধনই ছিল তাঁর শাসনের বৈশিষ্ট্য। তার পূর্বে রাজ্যে পণ্যের
ওজনের কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি বিদ্যমান ছিলনা। তিনিই পণ্যের ওজনের একক চালু করেন।
কোন দ্রব্য কত মূল্যে বিক্রয় হবে তার একটি তালিকা প্রত্যেকটি বাজারে টানিয়ে দেয়া
হয়েছিল। তিনি অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা ধারণ করতেন এবং স্বস্ব যোগ্যতা অনুযায়ী
নিয়োগ দিতেন গুরুত্বপূর্ণ বহুপদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগদেন শমশের গাজী। গঙ্গা
গোবিন্দ, হরিহর দেওয়ান, শ্রী চাঁদ ঠাকুর, রামধন বিশ্বাস, মনু সরকার ও তার পুত্র
কনুরাম, দু:খীরাম মন্ডল প্রমুখের নাম পাওয়া যায় গাজী নামায়। তিনি স্বয়ং একজন হিন্দু
ধর্মাবলম্বী নারীকে বিয়ের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেন।
ত্রিপুরার ইতিহাসে তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রশংসা করা হয়েছে। শমশের গাজীর
কঠোর সমালোচক কৈলাশচন্দ্র সিংহ লিখেছেন, “ধর্মপুর নিবাসী গঙ্গাগোবিন্দ প্রধান
দেওয়ান এবং খন্ডল নিবাসী হরিহর দেওয়ান পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন”। তিনি হিন্দু
মুসলমান নির্বিশেষে মুসলিম ধর্মপ্রচারক আর দরিদ্র ব্রাহ্মণদের নি:ষ্কর ভূমি দান
করেছিলেন। কৈলাশচন্দ্র সিংহ মহারাজ কৃষ্ণ মাণিক্যর প্রশংসা করতে যেয়ে তাঁর ভাষায়
“ডাকাইত শমশের গাজী কর্তৃক প্রদত্ত বহু নি:ষ্কর মিনা আর দেবোত্তর সম্পত্তি ফিরিয়ে
দেয়ার কথা বলেছেন”। এমনকি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক কদম মোবারক মসজিদ এবং ঢাকার
ঐতিহ্যবাহী হোসনী দালানের সাথেও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে শমশের গাজীর নাম।
যদিও হোসেনী দালানের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত নয়। শমশের গাজীর মৃত্যু
ইতিহাসের আরেক অজানা অধ্যায়। তার মুত্যুর সময় এবং স্থান নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্ক
রয়েছে তা সমসাময়িক ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তার মৃত্যু সম্পর্কে
প্রচলিত বক্তব্য গুলি নি¤œরূপ। ১) শমশের গাজীর বিচিত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৭৬০
সনে ( ত্রিপুরার রাজমালা-পুরঞ্জন প্রসাদ চক্রবর্তী)
২) নওয়াবের সাথে সাক্ষাতের কথা বলে ষড়যন্ত্র করে শমশের গাজীকে ধরে নিয়ে হত্যা
করা হয় ১৭৬০ সনে ( আলী নওয়াজ বাংলা পিডিয়া)
৩) মীর কাশিম বাংলার নবাব থাকাকালে সৈন্য পাঠিয়ে শমশের গাজীকে বন্দি করে নিয়ে
আসেন এবং তোপের মুখে ফেলে তাকে হত্যা করেন। (কুমিল্লা জেলার ইতিহাস- আবুল কালাম
মো. যাকারিয়া)
৪) মুর্শিদাবাদে আসাদুল্লাহ (নবাব সরফরাজ খাঁর উপাধি) নামক নবাবের নির্দেশে আগা
বাকের সৈন্যবাহিনী নিয়ে রোশনাবাদে উপস্থিত হন। মোবারকের ঘোনা নামক স্থানে তুমুল
যুদ্ধে শমশের পরাজিত হন। আগা বাকের শমশের কে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান
এবং তথায় কামানের সম্মুখে রাখিয়া উড়াইয়া দেয়া হয়। (আগা বাকের ও আগা সাদেক-
মৌলভি মোহাম্মদ মহতসম বিল্লাহ চৌধুরী - নবনূর- ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা)
৫) আগা বাকের এবং জসারত খাঁর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে শমশের গাজী মুর্শিদাবাদ হইতে রংপুরের
ঘোড়াঘাটে নীত হন এবং সেখানেই চরম দৈহিক নির্যাতনের মুখে ১৭৬১ সনে তাহার প্রাণ
সংহার হয়েছিল। (তিনহাজার বছরের নোয়াখালী- কাজী মোজাম্মেল হক।)
কৈলাশ চন্দ্র সিংহের মতে যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের আবেদনের প্রেক্ষিতে নবাব মীর
কাশিমের অনুমোদন ক্রমে শমশের গাজীকে হত্যা করা হয়। পক্ষান্তরে গাজী নামার লেখক
মনোহর শেখ শমশের গাজীর জগন্নাথ সোনাপুর ত্যাগের সময়কাল উল্লেখ করেন এভাবে -
“এগারশ উনষাইট সন জৈষ্ঠ্য মাসে।
জুম্মাবারে জান তুমি জোহরের শেষে।।
উনত্রিশ তারিখ সেই ছিল শুক্রবার ।
চলিল পশ্চিম মুখে গাজি মরিবার।।”
১১৫৯ বঙ্গাব্দ কে খৃষ্টাব্দ করলে তা ১৭৫২ খৃষ্টাব্দ হয়। সমসাময়িক সময়ের ইতিহাস
পর্যালোচনা করলে মনোহর শেখের বিবরণের কাছাকাছি সময়টিকেই আমাদের গ্রহণ করতে
হয়। ত্রিপুরা রাজবংশের বিষয়ে স্মৃতি নির্ভর এবং ফরমায়েশ অনুযায়ী লিখিত রাজমালা
(দরবারী ইতিহাস) এবং ত্রিপুরার ইতিহাসে বর্ণনা অনুযায়ী নবাব শমশের গাজী ১৭৪৭-৪৮
সালে ত্রিপুরা অধিকার করেন। এ দুই গ্রন্থ মতে মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফর খান এবং
পরবর্তীতে মীর কাশিম খান কোন একজনের শাসনকালে ও নির্দেশে শমশের গাজীর মৃত্যু ঘটে
এ ক্ষেত্রে নবাব মীর কাশিমের দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়। কিন্তু এটি মেনে
নেয়া কঠিন। কারণ পলাশীর যুদ্ধের পূর্বেই শমশের গাজী নিহত হন। গাজী নামার বিবরণ
অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি ১৭৫২ সনে ঢাকার
উদ্দেশ্যে জগন্নাথ সোনাপুর ত্যাগ করেন এবং তথায় তাহার জামাতা হোসাইন উদ্দিন খাঁর
গৃহে উপস্থিত হন। হোসাইন উদ্দিন খাঁ তখন ঢাকার জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। জনতার নিকট
তিনি নবাব হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। মুর্শিদাবাদে যাত্রার কথা বললে জামাতা তাকে
নিষেধ করেন। প্রতি উত্তরে গাজীর বক্তব্য খুঁজে পাই মনোহর শেখের লেখায়-
গাজীরে বলিল বাপু অতিশ্রদ্ধা মানে।
বারে বারে ডাকে মোরে না যাই কেমনে।।
ঢাকার ইতিহাসবিদের মতে তিনিই ঢাকার ডেপুটি নায়েবে নাজিম ছিলেন। তিনি
সিরাজ-উদ-দৌলার চাচা সম্পর্কিত ছিলেন। সিরাজের ঘনিষ্ট আগা সাদেকের সাথে তাঁর
বিরোধ তৈরী হয়। আগা সাদেকের ষড়যন্ত্রে ১৭৫৪ খৃষ্টাব্দের প্রথম দিকের এক রাতে
হোসেন উদ্দিন খাঁ-কে তাঁর বাস ভবনে ঘুমন্ত অবস্থায় নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়। এ সময়
মুর্শিদাবাদে নবাব হিসাবে আসীন ছিলেন আলীবর্দী খান মহাবত জঙ্গি। ১৭৫১ থেকে ১৭৫৩
খৃষ্টাব্দ ইসলামাবাদের (চট্টগ্রাম) শাসনকর্তা ছিলেন আগা বাকের। উল্লেখ্য, আগা বাকের
তখন বৃদ্ধ থাকায় জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) অবস্থান করতেন এবং তাঁর পক্ষে পুত্র আগা সাদেক
শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন অভিযোগের কারণে তাকে চট্টগ্রামের ফৌজদারের
পক্ষ হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু নবাব দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলার সাথে ঘনিষ্ঠতার
কারণে তাঁরা বহাল তবিয়তে ঢাকা অবস্থান করতে থাকেন এবং বিভিন্ন প্রকার প্রাসাদ
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। উপরোক্ত আগা বাকেরই শমশের গাজীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা
করেন। এ প্রসঙ্গে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত “নবনূর” পত্রিকার এক প্রবন্ধে বলা হয়
“খন্ডল প্রভৃত্তি স্থানের প্রাচীন দিকের মুখে শ্রুত হওয়া যায় রৌশানাবাদ বিজিত হইলে
তথায় শমশের গাজী স্বাধীন নরপতির ন্যায় রাজত্ব করিতে থাকেন।
ত্রিপুরাপতি রৌশনাবাদের রাজস্ব স্বরূপ নবাবের রাজকোষে যে কর প্রেরণ করিতেন শমশের
তাহা বন্ধ করিয়া দেন।”
প্রাচীনরা বলিয়া থাকেন এই সময়ে মুর্শিদাবাদে আসাদুল্লাহ্ নামের একজন নবাব রাজত্ব
করিতেন। তিনি আগা বাহার (আগা বাকের) নামক এক সামন্ত কে শমশেরের শাসনার্থে
প্রেরণ করেন। আগা বাকের সসৈন্যে রৌশনাবাদ প্রদেশে উপনীত হইলে শমশের মোবারক
ঘোনা নামক স্থানে তাহার গতিরোধ করার নিমিত্তে উপস্থিত হন। এ স্থানে উভয় পক্ষের
ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শমশের পরাজিত হন ও বন্দী হন। বাকের সমস্ত রৌশনাবাদ প্রদেশে
শান্তি স্থাপন পূর্বক শমশেরকে লইয়া মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তন করেন তথায় শমশেরকে
কামানের মুখে রাখিয়া উড়াইয়া দেওয়া হয়”। তাই গাজী নামায় বর্ণিত তারিখ এবং
সমসাময়িক ইতিহাসের ধরাবহিকতার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে একথা বলা যায় ১৭৫৪ সনের
মধ্যে কোন এক সময় শমশের গাজী নিহত হন।
কোন শাসকই বিতর্কের উর্দ্ধে নন, সে অর্থে শমশের গাজীও বির্তকের বাইরে থাকতে
পারেননা। শমশের গাজীকে মূল্যায়ন করতে গেলে সমসাময়িক ইতিহাসের আলোকে মূল্যায়ন
করতে হবে। সমসাময়িক ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি, যে স¤্রাট আওরঙজেব কে মোঘল
সা¤্রাজ্যের সবচাইতে ন্যায় পরায়ণ শাসক হিসেবে গণ্য করা হয় সেই আওরঙজেব
সিংহাসনের জন্য পিতা স¤্রাট শাহজাহানকে বন্দি করেন, ভ্রাতাদের নির্বিকার ভাবে
হত্যা করেন। যে বৈরাম খাঁ স¤্রাট আকবর কে অস্ত্রবিদ্যা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন স¤্রাট
আকবর তাকে স্বহস্তে হত্যা করেন। সরফরাজ খাঁর প্রধান সেনাপতি আলীবর্দি খাঁ সরফরাজ
খাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। শুধু তাই নয় দৌহিত্র সিরাজের
সিংহাসনে আসীনের পথকে মসৃন করার জন্যে কৌশলে হোসেন কুলী খাঁকে হত্যা করেন।
সিরাজের প্ররোচনায় আগা সাদেক ঢাকার ডেপুটি নায়েবে নাজীম হোসাইন উদ্দিন খাঁ কে
হত্যা করেন। হালাকু খাঁন, চেঙ্গিস খাঁন আর তৈমুর লং এর রক্তের বন্যা বইয়ে দেবার কথা
আর নাইবা বললাম। শমশের গাজীর রণকৌশল এবং শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে আমরা
দেখবো প্রতিভা, শক্তি ও সাহসে তিনি মারাঠা বীর শিবাজী, কিংবা আফগান শাসক
শেরশাহ চাইতে কোন অংশে কম না। বাংলার বার ভূঁইয়াদের শ্রেষ্ঠ ঈসা খাঁ,
প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়ের মতো জমিদারদের কর্মকা- যদি রাজনীতি হতে পারে, তবে
শমশের গাজীকে কেন আমরা মহান দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ বলবো না! শমশের গাজী তার
আভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কিছুটা চতুরতা, শঠতা কিংবা বেঈমানির আশ্রয় নিয়েছেন
হয়তো কিন্তু এর সবই ছিলো রাজনীতি এবং রণকৌশলের অংশ। গাজীকে যদি দস্যু বলা হয়,
তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতের প্রান্তে প্রান্তে যত রাজা, নবাব, সুলতানগণ
এক অন্যের রাজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন, রাজ্য স্থাপন করেছেন তাঁরাও যে দস্যু হয়ে
যান। বরং ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর তিনি অত্যাচারী শাসকে পরিণত না হয়ে, প্রজা
দরদী শাসকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি শাসন ব্যবস্থায় সাফল্যের জন্য প্রজাদের
সন্তুষ্টি বিধানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। ত্রিপুরার রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ সহ
সামন্তবাদীদের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধে তিনি শুধুমাত্র সমর শক্তি উপর নির্ভর না করে,
জনতার শক্তি এবং ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী। কৃষক প্রজাকে তার পক্ষে একত্রিত
করেছেন। তাইতো তিনি প্রলেতারিয়েতদের নায়ক, কৃষক-প্রজার প্রাণের নেতা। এখানেই
শমশের গাজী অনন্য সবার চেয়ে আলাদা। এখানেই তার মহত্ত্ব। এজন্যেই তিনি যুগ যুগ ধরে
বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
পাদটীকা: বাংলার নবাবের পক্ষে মীর হাবিব ১৭২৯ সনে ত্রিপুরা সমতল ভূমি জয় করেন।
যা বর্তমানে শহর কুমিল্লা এবং এর আশেপাশের এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। এ সংবাদ শ্রবণে
নবাব সুজাউদ্দিন এ অঞ্চলের নামকরণ করেন রোশনাবাদ অর্থাৎ আলোকের দেশ। এর পূর্ব
থেকে অবশ্য পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যটি “উদয়পুর সরকার” নামে বাংলার নবাবের অধীনস্ত
ছিল এবং ত্রিপুরার রাজা বাংলার নবাবকে নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করতেন। মীর হাবিব
কর্তৃক ত্রিপুরার সমতল ভূমি বা রোশনাবাদ জয় করার পর নবাব নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে
ত্রিপুরা রাজাকে তার জমিদারী বন্দোবস্ত প্রদান করেন।
তথ্যসূত্র:
১. শমশের গাজী - আহমদ মমতাজ, প্রকাশনায় বাংলা একাডেমি -২০১৩, ২. তিন হাজার
বছরের নোয়াখালীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস - কাজী মোজাম্মেল হক, প্রকাশনায় হীরামন
প্রকাশনী -১৯৮২, ৩. আহদিসুল খাওয়ানিন - মৌলভী হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর, অনুবাদ-ড.
খালেক মাসুকে রাসুল প্রকাশনায় অনুপম প্রকাশনী -২০১৩, ৪. শমশের গাজী ইতিহাসের
অজ্ঞাত পৃষ্ঠা - আব্দুল কুদ্দুস স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদনায় মামুন সিদ্দিকী -২০০২, ৫.
কিংবদন্তীর ঢাকা - নাজির হোসেন, প্রকাশনায় আজাদ মুসলিম কাব (৩য় সংস্করন) -১৯৯৫,
৬. ঢাকা স্মৃতি - বিস্মৃতির নগরী - মুনতাসীর মামুন, প্রকাশনায় অনন্যা -১৯৯৩, ৭.
রাজমালা - কৈলাশ চন্দ্র সিংহ - সম্পাদনায় ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী ও পূরঞ্জন
প্রসাদ চক্রবর্তী, প্রকাশনায় পারুল প্রকাশনী -২০০৯, ৮. নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা - আবুল
কালাম মো. যাকারিয়া, প্রকাশনায় প্রথমা প্রকাশনী -২০১৫, ৯. ঢাকার ইতিহাস -
যতীন্দ্র মোহন রায়, প্রকাশনায় গতিধারা -২০১২, ১০. শমশের গাজীর বিদ্রোহ (নাটক) -
আহমদ কবীর, প্রকাশনায় লায়লা প্রকাশনী -১৯৯৯, ১১. কুমিল্লা জেলার ইতিহাস - আবুল
কালাম মো. যাকারিয়া, প্রকাশনায় কুমিল্লা জেলা পরিষদ -১৯৮৪, ১২.
তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙ্গী - ইউসুফ আলী খান অনুবাদ আবুল কালাম মো. যাকারিয়া
- ১৯৯৭, ১৩. মোঘল রাজধানী ঢাকা - ড. আবদুল করিম অনুবাদ ড. মুহিবউল্যা সিদ্দিকী,
প্রকাশনায় জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন -২০১২।
লেখক পরিচিতিঃ সংগঠক ও গবেষক
মতামত জানাতে ০১৭১১ ৩৯ ৩৮ ৫৭

মূল লেখার লিংক 
https://vusukupa.blogspot.com/2019/07/blog-post_37.html?m=1

শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০

রমজানের যে আমলগুলো অবশ্যই করবেন : জাকির রুবেল

রমাদান মাস আল্লাহ তা‘আলা এক বিশেষ নিয়ামাত। সাওয়াব অর্জন করার মৌসুম। এ মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, রহমাত, বরকত ও নাজাতের মাস-রমাদান মাস। আলকুরআনে এসেছে: ‘‘রমাদান মাস, যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৫]
রমাদান মাসের ফযিলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘রমাদান- বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস রোযা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃংখলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল (মহা কল্যাণ হতে)’’ [সুনান আত-তিরমিযি: ৬৮৩]
এ মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যেগুলো পালন করার মাধ্যমে আমরা জান্নাতে যেতে পারি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি। নিম্নে রমাদান মাসের আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
রমাদান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো:-

[১] সিয়াম পালন করা:  ইসলামের পাঁচটি রুকনের একটি রুকন হল সিয়াম। আর রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ। সেজন্য রমাদান মাসের প্রধান আমল হলো সুন্নাহ মোতাবেক সিয়াম পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন: “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে, মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে” [সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫]
সিয়াম পালনের ফযিলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ইখলাস নিয়ে অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য রমাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’’ [সহীহ বুখারী : ২০১৪]
‘‘যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সিয়াম পালন করবে, তাদ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন’’। [সহীহ মুসলিম : ২৭৬৭]
[২] সময় মত সালাত আদায় করা: সিয়াম পালনের সাথে সাথে সময় মত নামায আদায় করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’ [সূরা নিসা : ১০৩]
এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে:আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, সময় মত নামায আদায় করা। [সহীহ মুসলিম : ২৬৩]
[৩] সহীহভাবে কুরআন শেখা: রমাদান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ মাসের অন্যতম আমল হলো সহীহভাবে কুরআন শেখা। আর কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে:‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’’ [সূরা আলাক : ১]
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শেখার নির্দেশ দিয়ে বলেন:‘‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’’ [মুসনাদ আলজামি : ৯৮৯০]
 [৪] অপরকে কুরআন পড়া শেখানো: রমাদান মাস অপরকে কুরআন শেখানোর উত্তম সময়। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৫০২৭]
‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দিবে, যত তিলাওয়াত হবে তার সাওয়াব সে পাবে’ [সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবুবিয়্যাহ : ০৭]
[৫] সাহরী খাওয়া: সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে: ‘‘সাহরী হল বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন’’ [মুসনাদ আহমাদ : ১১১০১, সহীহ]
[৬] সালাতুত তারাবীহ পড়া: সালাতুত তারাবীহ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবীহ পড়ার সময় তার হক আদায় করতে হবে। হাদীসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমাদানে কিয়ামু রমাদান (সালাতুত তারাবীহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’ [সহীহ আল-বুখারী : ২০০৯]
তারাবীহ এর সালাত তার হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবীহ জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে আছে: ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (সালাতুত তারাবীহ) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব দান করা হবে’’ [সুনান আবূ দাউদ : ১৩৭৭, সহীহ]

[৭] বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা: এটি কুরআনের মাস। তাই এ মাসে অন্যতম কাজ হলো বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’’ [সুনান আত-তিরমিযী: ২৯১০, সহীহ]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাদান ব্যতীত কোন মাসে এত বেশি তিলাওয়াত করতেন না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘‘রমাদান ব্যতীত অন্য কোনো রাত্রিতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোযা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখি নি’’ [সহীহ মুসলিম : ১৭৭৩]
 [৮] শুকরিয়া আদায় করা: রমাদান মাস পাওয়া এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। সেজন্য আল্লাহ তা‘আলার বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা এবং আগামী রমাদান পাওয়ার জন্য তাওফীক কামনা করা। রমাদান সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে: ‘‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৫]
‘‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন’।’’ [সূরা ইবরাহীম : ৭]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করে বলতেন অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য [সুনান আত-তিরমিযী : ২৭৩৮]
[৯] কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা: এ মাসটিতে একটি ভাল কাজ অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। সেজন্য যথাসম্ভব বেশি বেশি ভাল কাজ করতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৬৮৪]
 [১০] সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া: রমাদান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রমাদানের কারণে আরো বেশি ফজিলত রয়েছে। যেহেতু সাহরী খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রমাদান মাসে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’ [সহীহ মুসলিম : ২৮১২]

১১] বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা: এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]
[১২] উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা: রমাদান মাস নিজকে গঠনের মাস। এ মাসে এমন প্রশিক্ষণ নিতে হবে যার মাধ্যমে বাকি মাসগুলো এভাবেই পরিচালিত হয়। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, সে যেন তখন অশস্নীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, আমি রোযাদার’’ [সহীহ মুসলিম : ১১৫১]
[১৩] ই‘তিকাফ করা: ই‘তিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইসতিগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রমাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাদানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: ‘‘প্রত্যেক রমাযানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রমযানে তিনি ইতিকাফ করেছিলেন বিশ দিন’’ । দশ দিন ই‘তেকাফ করা সুন্নাত। [সহীহ আলবুখারী : ২০৪৪]
[১৪] দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা: রমাদান মাস হচ্ছে দ্বীনের দাওয়াতের সর্বোত্তম মাস। আর মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকাও উত্তম কাজ। এজন্য এ মাসে মানুষকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসার জন্য আলোচনা করা, কুরআন ও হাদীসের দারস প্রদান, বই বিতরণ, কুরআন বিতরণ ইত্যাদি কাজ বেশি বেশি করা। আলকুরআনের ঘোষণা : ‘‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি একজন মুসলিম’’ [সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৩৩]
হাদীসে এসেছে:‘‘ভাল কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’ [সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০]
 [১৫] সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করা: এ মাসে একটি উমরা করলে একটি হাজ্জ আদায়ের সমান সাওয়াব হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘রমাদান মাসে উমরা করা আমার সাথে হাজ্জ আদায় করার সমতুল্য’’ [সহীহ আলবুখারী : ১৮৬৩]
[১৬] লাইলাতুল কদর তালাশ করা: রমাদান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল-কুরআনের ঘোষণা: ‘‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’’ [সূরা কদর : ৪]
হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব পাওয়ার আশায় ইবাদাত করবে তাকে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৩৫]
এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রমদানের শেষ দশ দিনে অধিক হারে পরিশ্রম করতেন’’ [সহীহ মুসলিম : ১১৭৫]
 লাইলাতুল কদরের দো‘আ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর নবী ! যদি আমি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাই তবে কি বলব ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বলবেঃ ‘‘হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৩৫১৩]
[১৭] বেশি বেশি দো‘আ ও কান্নাকাটি করা: দো‘আ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এজন্য এ মাসে বেশি বেশি দো‘আ করা ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করা। হাদীসে এসেছে: ‘‘ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ রাববুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমাদানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে’’ [আল জামিউস সাগীর : ৩৯৩৩]
অন্য হাদীসে এসেছে: ‘‘রমযানের প্রতি দিবসে ও রাতে আল্লাহ তা‘আলা অনেককে মুক্ত করে দেন। প্রতি রাতে ও দিবসে প্রতি মুসলিমের দো‘আ কবূল করা হয়’’ [সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ১০০২]
 [১৮] ইফতার করা: সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ আমল। কোন বিলম্ব না করা । কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র ’’ [সুনান আবু দাউদ : ২৩৫৭, সহীহ]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন : “পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।” [সুনান আবূ-দাউদ: ২৩৫৯, সহীহ]
অপর বর্ণনায় যে এসেছে- “হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।” এর সনদ দুর্বল। আমাদের উচিত সহীহ হাদীসের উপর আমল করা। [সুনান আবু দাউদ :২৩৫৮] 
 [১৯] ইফতার করানো: অপরকে ইফতার করানো একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে একজনকে ইফতার করানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তাদের উভয়ের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না’’ [সুনান ইবন মাজাহ : ১৭৪৬, সহীহ]
২০] তাওবাহ ও ইস্তেগফার করা: তাওবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, গুনাহের কাজ আর না করার সিদ্ধান্ত নেয়া। এ মাস তাওবাহ করার উত্তম সময়। আর তাওবাহ করলে আল্লাহ খুশী হন। আল-কুরআনে এসেছে: ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাটি তাওবা; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত’’ [সূরা আত-তাহরীম : ৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর আমি দিনে তাঁর নিকট একশত বারের বেশি তাওবাহ করে থাকি’’ [সহীহ মুসলিম : ৭০৩৪]

 তবে তাওবাহ ও ইস্তেগফারের জন্য উত্তম হচ্ছে, মন থেকে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়া, আর তা হচ্ছে ‘‘হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া প্রকৃত এবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার গোলাম আর আমি সাধ্যমত তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকারের উপর অবিচল রয়েছি। আমার কৃত-কর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে যত নেয়ামত দিয়েছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করছি। যত অপরাধ করেছি সেগুলোও স্বীকার করছি। অত:এব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’’

ফযিলাত: ‘‘যে কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলা এই দু‘আটি (সাইয়েদুল ইসতিগফার) পাঠ করবে ঐ দিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে এবং যে কেউ ইয়াকিনের সাথে রাত্রিতে পাঠ করবে ঐ রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে।’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৬৩০৬]

 [২১] তাকওয়া অর্জন করা: তাকওয়া এমন একটি গুণ, যা বান্দাহকে আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করে। আর রমাদান মাস তাকওয়া নামক গুণটি অর্জন করার এক বিশেষ মৌসুম। কুরআনে এসেছে: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা এর মাধ্যমে তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৩]

যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। [সূরা তালাক : ০২]

 [২২] ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা:ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা। এটি একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ফজর জামাআত আদায় করার পর সূর্য উদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করবে, অতঃপর দুই রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে পরিপূর্ণ হাজ্জ ও উমারাহ করার প্রতিদান পাবে। [সুনান আত-তিরমিযী : ৫৮৬]

 [২৩] ফিতরাহ দেয়া: এ মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে ফিতরাহ দেয়া আবশ্যক। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাত আদায়ের পুর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন। [সহীহ আল-বুখারী :১৫০৩]

 [২৪] অপরকে খাদ্য খাওয়ানো: রমাদান মাসে লোকদের খাওয়ানো, বিশেষ করে সিয়াম পালনকারী গরীব, অসহায়কে খাদ্য খাওয়ানো বিরাট সাওয়াবের কাজ । কুরআনে এসেছে: তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। [সূরা আদ-দাহর: ৮]

এ বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: ‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১২]

অপর বর্ণনায় বর্ণিত আছে যে :‘‘যে কোনো মুমিন কোনো ক্ষুধার্ত মুমিনকে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। [বাইহাকী, শু‘আবুল ইমান : ৩০৯৮, হাসান]

 [২৫] আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত করা: আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তা রক্ষা করাও একটি ইবাদাত। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘‘আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আরও তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা আন-নিসা: ১]

আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“সালাম বিমিয়ের মাধ্যমে হলেও আত্নীয়তার সম্পর্ক তরতাজা রাখ।” [সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবওয়িয়্যাহ : ১৩]

 [২৬] কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা: কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এ দায়িত্ব মূলত বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানোর মাধ্যমেই সম্পাদন করেন। কুরআনে এসেছে: ‘‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’ [সূরা আল-হিজর: ৯]

যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম।আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘কুরআনের ধারক-বাহককে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হবে” [সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪]

[২৭] আল্লাহর যিকর করা: এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহ তা’আলা চারটি বাক্যকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন, তাহলো যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি  পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি  পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে পড়বে, তার জন্য ত্রিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়’’। [মুসনাদ আহমাদ : ১১৩৪৫]

[২৮] মিসওয়াক করা: মেসওয়াকের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদীসে এসেছে: অর্থাৎ মেসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী, এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রেখেও মেসওয়াক করতেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। [সহীহ ইবন খুযাইমাহ : ১৩৫]

 [২৯] একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো: রমাদান মাসে একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো একটি উত্তম আমল। এটিকে দাওর বলা হয়। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে: জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমাদানের প্রতি রাতে রমাদানের শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল তাকে কুরআন শোনাতেন। [সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]

ইবনে হাজার রাহেমাহুল্লাহ্ বলেন : জিবরাইল প্রতি বছর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এক রমযান হতে অন্য রমযান অবধি যা নাযিল হয়েছে, তা শোনাতেন এবং শুনতেন। যে বছর রাসূলের অন্তর্ধান হয়, সে বছর তিনি দু বার শোনান ও শোনেন ।
৩০] কুরআন বুঝা ও আমল করা: কুরআনের এ মাসে কুরআন বুঝা ও আমল করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে: ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’। [সূরা আল-আ‘রাফ : ৩]

কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: ‘আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম’ [শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০]

যা করণীয় নয়:
রমাদান মাসের ফজিলত হাসিল করার জন্য এমন কিছু কাজ রয়েছে যা থেকে বিরত থাকা দরকার, সেগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

1. বিলম্বে ইফতার করা
2. সাহরী না খাওয়া
3. শেষের দশ দিন কেনা কাটায় ব্যস্ত থাকা
4. মিথ্যা বলা ও অন্যান্য পাপ কাজ করা
5. অপচয় ও অপব্যয় করা
6. তিলাওয়াতের হক আদায় না করে কুরআন খতম করা
7. জামা‘আতের সাথে ফরয সালাত আদায়ে অলসতা করা
8. বেশি বেশি খাওয়া
9. রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা
10. বেশি বেশি ঘুমানো
11. সংকট তৈরি করা জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির জন্য
12. অশ্লীল ছবি, নাটক দেখা
13. বেহুদা কাজে রাত জাগরণ করা
14. বিদ‘আত করা
15. দুনিয়াবী ব্যস্ততায় মগ্ন থাকা

প্রিয় পাঠক!
রমাদান মাস পাওয়ার মত সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে! আমরা যদি এ মাসের প্রতিটি আমল সুন্নাহ পদ্ধতিতে করতে পারি তবেই আমাদের রমাদান পাওয়া সার্থক হবে।কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেলো অথচ তার গুনাহ মাফ করাতে পারল না সে ধ্বংস হোক।’’ [শারহুস সুন্নাহ : ৬৮৯] আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রমাদান মাসের ফজিলত হাসিল করার তাওফীক দিন। 

আমীন!
কোরআনের আলো ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত। 

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০২০

নন এমপিও শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ____জাকির রুবেল

করোনা মহামারী থেকে রক্ষা পেতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো এখন বন্ধ। জুন মাসের আগে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার কোন লক্ষণই নেই। এখন দেশে নন এমপিও শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ(৯৫ হাজার)।এসব নন এমপিও শিক্ষকরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে একেবারে সামান্য বেতন পেয়ে এবং প্রাইভেট বা টিউশনি করে। কিন্তু গতমাস এবং আগামী ২/৩মাস সহ  মোট ৩/৪ মাস এরা সম্পূর্ন বেকার এবং এদের বেশিরভাগ শিক্ষকই নিম্ম মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত। এরা শিক্ষক বিধায় কারো কাছে হাতও পাততে পারবেনা৷ কারন সবাই মনে করে শিক্ষদের কাছে এখন অনেক টাকা!  অনেক শিক্ষকই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে যাদের কথা কান পেতে শোনার কেও আছে?
নরমাল একটা হিসেব করি আসুন যদি এই  একজন নন এমপিও শিক্ষক মাসে নূন্যতম ৮০০০/-  বাসা ভাড়া,গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল  ৫০০০/- খাবার খরচ, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ ৫০০০/-  করেও ধরি তাহলে 
মাসে ১৮০০০ টাকা হয়। এদের ফ্যামিলি ও অন্যান্য খরচ না ধরলেও এ টাকা দরকার। 

এখন দেখেন এদের জন্য কারো কোন মাথাব্যাথা আছে কি?  সরকারি ও এমপিওরা মাসে মাসে ঠিকই ঘরে বসে তাদের বেতন ভাতাদি পেয়ে যাবেন। কিন্তু এই ননএমপিওদের কি হবে? দেশের শিক্ষা সম্প্রসারনে কি এদের কোন অবদানই নেই? এই যে ননএমপিও ৫০০০ স্কুলের শিক্ষকরা এখন করবে কি?  চলবে কিভাবে? কার কাছে বলবে এদের এই দুঃখের কথা?  

সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের কাছে আকুল আবেদন এই তিন চারমাস এদের জন্য প্রনোদনা দিয়ে এই শিক্ষক সমাজদেরকে বাঁচান। জানি কোন শিক্ষকই তাদের দুর্দিনের কথা লজ্জায় কাওকে বলতে পারবে না। পারবেনা লাইনে দাঁড়াতে ত্রানের জন্য। হয়তো অনেকে বলবেন এই তিনমাস এদের প্রতিষ্ঠানকি এদের বেতন দিবেনা? নন এমপিও শিক্ষকদের বেতন কত তা কি কেও জানেন? যে বেতন প্রতিষ্ঠাগুলো দেয় এতে তাদের যাতায়াত খরচও হয়না। বাকিটা নাই বললাম। 

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবাইকে অনুরোধ করছি জাতির এই ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের বাঁচাতে আপনারা এগিয়ে আসুন৷ এই ৩/৪ মাস এদের প্রনোদনা দিলে সরকারের মাত্র (৩*২০০০০=৬০০০০/- *১০০০০০=৬০০০০০০০০০/-)মাত্র ৬০০ কোটি টাকা। আর আপনি /আপনারা করেনার  এই দূর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য বরাদ্দ করেছেন ৭২ হাজার কোটি টাকা। যেখানে আমার দেশের বাৎসরিক বাজেট এখ ৫ লাখ কোটি টাকা। মাত্র ৬০০ কোটি সেখানে কিছুইনা। আর সকল পেশার লোকেরা প্রণোদনা পেলে জাতী গঠনের কারিগররা কেন পাবেনা?

জাকির রুবেল 
শিক্ষক
হলি ক্রিসেন্ট স্কুল,ফেনী
শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সার সড়ক,ফেনী শহর। 
১০/০৪/২০২০ খ্রীষ্টাব্দ।

শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০২০

মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রকাশ্যে দান করা যেতে পারে, তবে গোপনে দান করা বেশি ভালো।

"যারা তাদের সম্পদ দিন-রাত প্রকাশ্যে, গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে "— আল-বাক্বারাহ ২৭৪

যারা তাদের সম্পদ দিন-রাত প্রকাশ্যে, গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে — তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে রাখা আছে। তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো আফসোস করবে না। [আল-বাক্বারাহ ২৭৪]
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى সেই সব মানুষদের কথা বলেছেন, যারা সবসময় দান করেন। দিনের বেলা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো অভাবীকে দেখলে দান করেন। কোনো সংগঠন এসে সাহায্য চাইলে দান করেন। কেউ তাকে অভাবী মানুষের দুর্দশার কথা শোনালে তিনি দান করার জন্য ছুটে যান। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারিতে দুস্থ মানুষদের দান করার সুযোগ পেলে তিনি কখনও ছেড়ে দেন না। আত্মীয়রা চাওয়ার আগেই তিনি তাদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেন। মসজিদে কারও চেহারা দেখে সে কষ্টে আছে মনে হলে, তিনি তার কষ্ট কমাতে এগিয়ে যান। এই ধরনের নিবেদিত প্রাণ মানুষরা দিনে, রাতে, প্রকাশ্যে, গোপনে যখন যেভাবে পারেন দান করতে থাকেন। এদের সম্পর্কে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এদের পুরস্কার বিশেষভাবে তাঁর تعالى কাছেই জমা আছে। এরা কিয়ামতের দিন যখন তাঁর تعالى কাছে আসবেন, সেদিন তাদের কোনো ভয়, কোনো আফসোস বা দুঃখ থাকবে না। আল্লাহ تعالى এদেরকে বিরাট পুরস্কার দেবেন। এমন পুরস্কার, যা তিনি تعالى নিজের কাছে রেখেছেন। অন্য কাউকে তিনি تعالى এত বড় পুরস্কার ধরে রাখার জন্য যোগ্য মনে করেননি।

প্রশ্ন হচ্ছে: কেন দানশীলদের জন্য এত বড় পুরস্কার? এই ধরনের পুরস্কার কি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, নিয়মিত রোজাদারদের জন্য থাকা উচিত ছিল না?

ঘরে বসে নামাজ, রোজা করা সোজা কাজ। কিন্তু নিজের কষ্টের সম্পদ কাউকে দান করা কঠিন ব্যাপার। দান করতে গেলেই মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা শুরু হয়ে যায়, “যদি দান করি তাহলে বাচ্চার পড়ার খরচের জন্য টাকা থাকবে? আগামী কয়েকমাস বাড়ি ভাড়া দিতে পারবো? পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার টাকা কীভাবে দেব? গাড়ি-বাড়ি কেনার জন্য টাকা জমাবো কীভাবে?” — যখনি আমরা কোনো দান করার পরিস্থিতিতে পড়ি, তখনি আমরা একেক জন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হয়ে যাই। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের যাবতীয় সম্পদ, বিনিয়োগ এবং ঝুঁকির হিসাব মাথার মধ্যে গিজগিজ করতে থাকে। দান করতে গেলেই বোঝা যায় কার আল্লাহর تعالى প্রতি বিশ্বাস কতটা দৃঢ়।

একারণেই যারা নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে জয়ী হয়ে দিন-রাত দান করতে পারেন, তাদের বিশ্বাস অত্যন্ত মজবুত হয়ে যায় এবং তাদের অন্তর খুবই শক্তিশালী হয়ে যায়। তখন তাদের ভেতরে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যেমন, আল্লাহর تعالى প্রতি আস্থা অনেক বেড়ে যায়, ভবিষ্যৎ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করা কমে যায়, অমূলক ভয়-ভীতিকে তারা জয় করেন, নেতিবাচক চিন্তা কমে যায়, অন্যের প্রতি আত্মত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি হয়, সহমর্মিতা বোধ বাড়ে। একারণেই যারা নিয়মিত দান করেন, তাদের অন্তর মজবুত হয়, অল্পতেই মন ভেঙ্গে পড়ে না। দান করাটা হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতিতেও অন্তরকে আল্লাহর تعالى আদেশ মানানোর জন্য এক ধরনের ট্রেনিং। দুর্ভিক্ষ, মহামারি বা কষ্টের সময় মানুষকে দান করা, যখন কিনা নিজেরই অভাব চলছে, আত্মীয়দেরকে দান করা যাদের সাথে সম্পর্ক ভালো না—এগুলো বেশ কঠিন কাজ। এগুলো আমাদেরকে সহজ, আরামের ইবাদতের গণ্ডি থেকে বের করে, কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর تعالى প্রতি আস্থা রাখা, তাঁর تعالى আদেশ মেনে চলার ট্রেনিং দেয়।[৭]



যারা তাদের সম্পদ দিন-রাত প্রকাশ্যে, গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে

মানুষের ভিতরে স্বার্থপরতা এবং কৃপণতা স্বভাবজাত। মানুষ সবসময়ই চেষ্টা করে নিজের লাভের জন্য কাজ করার। নিজের সম্পদকে যতটুকু সম্ভব আগলে রাখার, যেন সে নিজের সম্পদ নিজে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ تعالى এমন মানুষদের কথা বলছেন, যারা তাদের স্বার্থপরতা এবং কৃপণতাকে জয় করতে পেরেছে। এরা দিন-রাত দান করে। যখন, যেভাবে পারে আল্লাহর تعالى পথে তাদের সম্পদ খরচ করে। যারা মানুষের এই দুটি দুর্বলতাকে জয় করতে পারেন, তারা আল্লাহর تعالى বিশেষ অতিথি হয়ে যান।

শুধু তাই না, এরা অভাবের সময়ও দান করেন। আল্লাহ تعالى এদের সম্পর্কে বলেছেন—

তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করো এবং এমন এক বাগান পাওয়ার জন্য ছুটে যাও, যেই বাগান সবগুলো আকাশ এবং পৃথিবীর আকৃতির মতো বিশাল, যা তৈরী করা হয়েছে আল্লাহর প্রতি সবসময় সাবধানীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। আর যারা ভালো কাজ করে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের ভালবাসেন। [আলে ইমরান- ১৩৩-১৩৪]
তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে রাখা আছে

এই আয়াতে আল্লাহর تعالى শব্দ চয়ন সূক্ষ্ম। তিনি বলেননি مَعَ رَبِّهِمْ বরং তিনি বলেছেন عِندَ رَبِّهِمْ। আরবিতে ‘কাছে রয়েছে’ বোঝানোর জন্য দুটো শব্দ রয়েছে مَعَ মা’আ এবং عِندَ ই’ন্দা। মা’আ সাধারণত ব্যবহার করা হয় কোনো কিছু অন্য কিছুর সাথে রয়েছে বোঝানোর জন্য।[১১] কিন্তু ই’ন্দা ব্যবহার করা হয় কোনো কিছু অন্য কিছুর সাথে যেখানে থাকা যথাযথ, ঠিক সেখানেই রয়েছে—এটা বোঝানোর জন্য।[১১] যেমন, আমরা যদি বলি: ছাত্রটি প্রধান শিক্ষকের সাথে কোথাও রয়েছে — সেক্ষেত্রে মা’আ ব্যবহার করব, কারণ ছাত্রটি হয়ত প্রধান শিক্ষকের সাথে বাজার করতে গেছে।[১১] কিন্তু যদি বলি: ছাত্রটি প্রধান শিক্ষকের সাথে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে রয়েছে — তাহলে ই’ন্দা, কারণ সেখানে প্রধান শিক্ষক তার যথাযথরূপে রয়েছেন। এই আয়াতে আল্লাহ تعالى সুন্দর করে বলেছেন: তাদের জন্য যে শুধু পুরস্কার রয়েছে তা-ই নয়, সেই পুরস্কার রয়েছে একদম যথাযথ জায়গায়: আল্লাহর تعالى নিজের কাছে।[১১] এছাড়াও এই আয়াতে তিনি বিশেষভাবে বলেছেন, “তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে।” তিনি বলেননি “আল্লাহর কাছে রয়েছে”। “তাদের রব” শব্দটি ব্যবহার করে তিনি تعالى তাদের সাথে তাঁর تعالى ঘনিষ্ঠতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

আমরা যখন খবর পাই যে, আমাদের কোনো বিশেষ অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে আমাদেরকে পুরস্কার দেবেন, তখন আমাদের খুশি দেখে কে? আমাদের নিকটআত্মীয়রা গর্ব করে বলে বেড়ায়, “ওকে প্রধানমন্ত্রী নিজে পুরস্কার দেওয়ার জন্য ডেকেছেন! আমাদের চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পায়নি। কত বড় সম্মান আমাদের!” আর এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এই ধরনের দানশীল, নিবেদিত মানুষদের পুরস্কার তিনি تعالى নিজের কাছে রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তাদেরকে তিনি تعالى নিজে পুরস্কার দেবেন। বিশ্বজগতের প্রতিপালক নিজে এসে পুরস্কার দেওয়া কী বিরাট ব্যাপার হতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। কিয়ামতের দিন এই চরম সৌভাগ্যবান মানুষগুলোর কোনো ভয় থাকবে না, যেদিন আমরা সবাই ভয়ে, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকবো। যেদিন আমরা দুনিয়ায় করা হাজারো ভুলের জন্য দুঃখে, আফসোসে মরে যেতে চাইবো, সেদিন এই দানবীরদের কোনো দুঃখ, আফসোস থাকবে না। তারা থাকবেন আল্লাহর تعالى একান্ত সান্নিধ্যে, চিরসুখী।

সুরাহ আল-বাক্বারাহ’তে ধারাবাহিকভাবে প্রায় দশটি আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। এই আয়াত সেই ধারাবাহিক আয়াতগুলোর শেষ আয়াত। আমরা প্রথম থেকে সবগুলো আয়াত যদি পড়ি, তাহলে আমরা পুরো ছবিটি দেখতে পাবো—

[২৬১] যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ খরচ করে, তাদের উপমা হলো একটি শস্য বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মে, প্রতিটি শীষে থাকে একশটি শস্য বীজ। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহর ভাণ্ডার অনেক প্রশস্ত, তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন।  [২৬২] যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ খরচ করে, তারপরে দানের কথা মনে করিয়ে খোটা দেয় না বা কোনো কষ্টও দেয় না, তারাই তাদের রবের কাছে প্রতিদান পাবে, তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো দুঃখও করবে না।  [২৬৩] দান করে তারপর কষ্ট দেওয়ার থেকে সুন্দর কথা বলা এবং ক্ষমা করা উত্তম। আল্লাহ ধনী-অভাবহীন এবং একইসাথে অত্যন্ত সহনশীল।

[২৬৪] বিশ্বাসীরা শোনো, দানের কথা মনে করিয়ে খোটা দিয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে বরবাদ করে দিয়ো না, সেই লোকের মতো, যে কিনা দান করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে না। ওর উদাহরণ হলো একটা বড় পাথরের মতো, যার উপরে কিছুটা মাটির আস্তর জমে, কিন্তু তারপর ভারি বৃষ্টি এসে সব মাটি ধুয়ে আবার খালি পাথর রেখে যায়। সে যা অর্জন করলো, তার কিছুই তার আর কাজে লাগলো না। আল্লাহ অবিশ্বাসী লোকদের পথ দেখান না।  [২৬৫] আর যে আল্লাহকে খুশি করার আশায় এবং নিজের বিশ্বাসকে মজবুত রাখার জন্য তার সম্পদ খরচ করে, তার উপমা হলো উঁচু ভূমিতে গাছে ঘেরা এক ঘন সবুজ বাগানের মতো, যেখানে ভারি বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফলন হয়। আর ভারি বৃষ্টি যদি না-ও হয়, হাল্কা ঝিরঝির বৃষ্টিই তার জন্য যথেষ্ট। তোমরা যা কিছুই করো, আল্লাহ তার সব দেখেন।

[২৬৬] তোমাদের মধ্যে কেউ কি চাইবে যে, তার একটি গাছে ঘেরা ঘন সবুজ বাগান থাকুক, আঙুর এবং খেজুরে ভরা, যার ভেতর দিয়ে ঝর্ণা ধারা বয়ে যায়, যেখানে সব ধরনের ফল-ফসল হয়, আর সে একসময় বয়সের ভারে নুয়ে পড়ুক এবং তার সন্তানগুলোও হোক দুর্বল? তারপর এক আগুনের ঘূর্ণি এসে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিক? এভাবেই আল্লাহ তোমাদেরকে তার বাণী পরিষ্কার করে দেন, যেন তোমরা চিন্তাভাবনা করো।

[২৬৭] বিশ্বাসীরা শোনো, তোমরা যা কিছু অর্জন করেছ, আর যা কিছু আমি তোমাদেরকে পৃথিবী থেকে দিয়েছি, তার মধ্যে থেকে ভালোগুলো আল্লাহর পথে খরচ করো। খারাপ জিনিসগুলো দেওয়ার নিয়ত করবে না, যেগুলো যদি কেউ তোমাদেরকে দিত, তাহলে তোমরা ঘৃণায় চোখ বুজে তা নিতে। আর জেনে রেখো, আল্লাহ সকল চাহিদার ঊর্ধ্বে, তিনি অত্যন্ত প্রশংসিত। 

[২৬৮] শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায়, আর তোমাদেরকে অশ্লীল কাজ করতে তাগাদা দেয়। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং প্রাচুর্যের নিশ্চয়তা দেন। আল্লাহ তো সবকিছু ঘিরে আছেন, তিনি সব জানেন।  [২৬৯] তিনি যাকে চান, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে গেছে। আর চিন্তাশীল মানুষরা ছাড়া কেউ শিক্ষা নেবে না।

[২৭০] তোমরা যা কিছুই খরচ করো, বা যেটাই মানত করো, আল্লাহ অবশ্যই তা জানেন। আর যালিমদের সাহায্য করার কেউ নেই। [২৭১] তোমরা যদি তোমাদের দানের কথা প্রকাশ করে দাও, তাহলে তাতেও কল্যাণ আছে। আর যদি তা গোপন রাখো এবং তা অভাবীদের দাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য আরও বেশি ভালো হবে। তোমাদের গুনাহগুলোর কিছু মাফ করার উপায় হয়ে যাবে। আর তোমাদের সব কাজের ব্যাপারে আল্লাহ খবর রাখেন।

[২৭২] ওরা সঠিক পথে চলল কি না, তা তোমার দায়িত্ব নয়। বরং আল্লাহ যাকে চান, তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসেন। তোমরা ভালো যা কিছুই খরচ করো না কেন, সেটা তোমাদের স্বার্থেই হবে, কারণ তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহকে পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তা খরচ করো। আর ভালো যা কিছুই তোমরা খরচ করবে, সেটার পুরো প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে। তোমাদের উপর একটুও অন্যায় করা হবে না।

[২৭৩] তোমাদের দান সেই অভাবীরা পাবে, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে নিবেদিত যে, তারা জীবিকার খোঁজে বের হতে পারে না। তারা মানুষের কাছে হাত পাতেন না দেখে অজ্ঞরা মনে করে যে, তাদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তুমি তাদের লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল করলে বুঝতে পারবে। তারা কখনও নাছোড়বান্দার মতো চায় না। আর তোমরা ভালো যা কিছুই দান করবে, আল্লাহ অবশ্যই সে ব্যাপারে সব জানেন।  [২৭৪] যারা তাদের সম্পদ গোপনে এবং প্রকাশ্যে রাতের বেলায় এবং দিনের বেলায় আল্লাহর পথে খরচ করে — তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো আফসোস করবে না।
এই আয়াতগুলো থেকে আমরা বেশ কিছু শিক্ষা নিতে পারি—

১) দান করে দানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দিলে তা বরবাদ হয়ে যায়।
২) দান করার সময় আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে খুশি করার আশা থাকলে, বা লোক দেখানো দান হয়ে গেলে তা বরবাদ হয়ে যায়।
৩) মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রকাশ্যে দান করা যেতে পারে। তবে গোপনে দান করা বেশি ভালো।
৪) সম্মানিত মানুষরা অভাবের সময় অন্যের কাছে হাত পাতেন না। আমাদেরকে বুঝতে হবে কাদের সাহায্য দরকার এবং নিজে থেকে এগিয়ে যেতে হবে সাহায্য করার জন্য।
৫) ঠিকভাবে দান করলে তার সাতশ গুণ বেশি পুরস্কার আল্লাহ দেবেন। শুধু তাই না, যাকে ইচ্ছা আরও বাড়িয়ে দেবেন।
৬) যারা নিয়মিত দান করে, তাদের কোনো ভয় নেই, তারা কোনো আফসোস করবে না।

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২০

পেশা যখন শিক্ষকতা

আকমল হোসেন: মনীষী সক্রেটিস এর ভাষায়- “পৃথিবীটা একটা নাট্যমঞ্চ। জগতের সকল মানুষই পৃথিবী নামক নাট্যমঞ্চের অভিনেতা। প্রত্যেক মানুষের পদ ও পদবির আলোকে তার রোল-প্লে থাকে। এটার ব্যতিক্রম হওয়াই একটা সমস্যা।” বাঙালি প্রবাদে বলে আগে দর্শনদারী পরে গুণবিচারী। কাঁধে ঝুঁড়ি হাতে বাঁশি দেখলেও তাকে যেকেউ বলবে তিনি সাপুড়ে। রাজমিস্ত্রি মানেই কন্যে, কড়াই, গজকাঠি; খেতমজুর মানেই কাস্তে মাথাল ইত্যাদি। এই যদি হয় পেশার দর্শনদারীতত্ত্ব তাহলে মানুষ গড়ার কারিগর অথবা দ্বিতীয় জন্মদাতা শিক্ষকের দর্শনদারীর কি হবে? আর গুনবিচারীরই কি হবে? সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বাট্রান ও রাসেল এর জবাব দিয়েছেন। তাদের মতে, শিক্ষকের কাজ দুটি। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলা, দ্বিতীয়ত, সেই আগ্রহ নিবৃত করা। কাজ দুটি বাক্যের মধ্যে যত সহজভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে, প্র্যাকটিকেলি ততটা হয়তো সহজ নয়। সহজ নয় বলেই এ পেশার নাম শিক্ষকতা। আর যারা এটা সহজ করতে পেরেছেন তারাই শিক্ষক, তাদের পরেই মাথানত করে তার শিক্ষার্থীরা। বেনামের ভিড়ে খাটি যাচাই করা কঠিন, তারপর শিক্ষকসমাজ আজও সম্মানের যে জায়গায় অবস্থান করেছেন, টাকা আয় অর্থ বৃত্তে সেটা হওয়ার নয়। কারণ নার্সের সেবায় বিনিময় মূল্য আছে, অর্থের পরিমাণ যোগ্য ও কিন্তু মায়ের সেবায় অর্থ মূল্য যোগ্য নয়। মায়ের সেবায় অর্থ মূল্যে বিবেচনায় করলে মায়ের প্রতি ঐ শ্রদ্ধা হয়তো থাকবে না। শিক্ষকের ক্ষেত্রে ঠিক একই উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে প্রকৃতির অপার লীলা, বৃহৎজগৎ এখনও মানুষের জানার বাইরে। হাজারো কোটি প্রাণবৈচিত্র্যে এখনও মানুষের সর্বত্রই এবং ‘‘মানুষ জ্ঞানের আধার।’’ মানুষ ছাড়া বিশ্ব জগৎ অচল। মানুষের সৃষ্টি মানুষ প্রকৃতিকেই সাজিয়েছে আপন মনে। মানুষের প্রয়োজনে মানুষের দ্বারাই সজ্জিত হয়েছে বিশ্ব জগতের নানামুখি কর্মকাণ্ড। এর মাঝেও মানুষরূপী অমানুষের দ্বারা মানবতাবিরোধী অনেক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে, পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করতে এসেছে নানান তন্ত্র, মন্ত্র, ধর্ম ও আইন। প্রাণ নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়া মানব সন্তানকে মানুষ করতে (জ্ঞানী প্রাণী) নানামুখি শিক্ষা এবং অনুশীলনের আর্বিভাব। জৈবিক চাহিদা নিয়ে জন্ম নেয়া আদম সন্তানদের প্রাণির বিরুদ্ধে মনুষ্যত্ব অর্জনে অভ্যুদয় ঘটেছিল শিক্ষার। ক্ষুধা, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া প্রদান, শীত-গ্রীষ্মের অনুভূত আর বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার নিজস্ব তাগিদ থেকে অবচেতন মনেই সে কিছু বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেছিল। শিক্ষার অন্যতম একটি লক্ষ্য বাস্তবায়নের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা অর্জন। বন্য জীবজন্তু থেকে রক্ষা পেতে এবং খাদ্যের প্রয়োজনে দলবদ্ধভাবে বসবাস থেকে মানুষের মধ্যে যে সামাজিকতার সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও বিদ্যমান, তবে ভিন্ন প্যাটানে। শহরে নগর জীবনের ক্ষেত্রে এর কিছু ব্যতিক্রম, গ্রামভিত্তিক জীবনে এটা এখনও সচল এবং ব্যাপক। দূর্গম গিরিপথ আর সাগর নদীর তলদেশে আবাসন আর যাতায়াতের উন্নত ব্যবস্থা। শিক্ষার জগতে হাজারগুণ উন্নতি তারপরও মায়ের শিক্ষাই শিশুর আদি এবং অকৃত্তিম। মায়ের শিক্ষা পারিবারিক শিক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কিন্তুু শুরুটা মায়ের কাছ থেকে তারপর পরিবার এবং সমাজ, সর্বশেষ প্রতিষ্ঠান/শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার বিষয়বস্তুু হিসেবে প্রথমেই যে বিষয়টি এসেছিল সেটি হলো প্রকৃত ঘটনা, বাঙালি প্রবাদে তার নিদর্শন পাওয়া যায়, কোথায় শিখি-যেথায় ঠেকি। এটাই হলো শিক্ষার মূল জায়গা। এর পর এসেছে অলৌকিতা/ভাববাদ। ভাববাদী দর্শন নিয়েই প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার যাত্রা। পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ইতিহাস তেমনটাই প্রমাণ করে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং তাদের জীবন ও জীবিকা সেই সাথে সুন্দর ভবিষৎ গড়তে নতুন চিন্তা হিসেবে যুক্তি/দর্শন এর পর সেটা আরও আধুনিক ও যুক্তিবাদী করতে বিজ্ঞানকে শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছে। যারা এটাকে গ্রহণ করেছে তারা সামনে এগিয়েছে, আর যারা সেটা গ্রহণ করেনি তারা অনেক পিছিয়ে আছে। বর্তমান পৃথিবীতে ৭০০ কোটি মানুষ। এরপরও বাড়তেই থাকবে। এদের নানামুখি চাহিদা বাড়বে। তবে প্রকৃতিতে সেই হারে সম্পদ বাড়ার সুযোগ নেই। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর নানামুখি চাহিদা মিটাতে প্রকৃতির এই সম্পদের নানামুখি ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। আর এর জন্যই প্রয়োজন শিক্ষা এবং সেই শিক্ষাকে হতে হবে যুগের চাহিদা মিটানোর ক্ষমতা। সেই কারণে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন হতে হবে যেন সে যুগের চাহিদা মিটাতে পারে। আর যারা এই শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখবেন তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং ক্ষমতা অর্জন জরুরি। শিক্ষাকতা আর পাঁচটি পেশার মত গতানুগতিক কোন কাজ নয়। বস্তুুগত জিনিস দেয়ার বিষয়ও নয়। কাদামাটি দিয়ে কুমার যেমন বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র নির্মাণ করেন, শিক্ষককেও সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রাণিত্বকে মনুষ্যতে পরিণত করার কাজটি কিন্তু এতো সহজ নয়, শিক্ষককেই সেই কঠিক কাজটি সহজ করতে হয়। এ জন্য সমাজ, রাষ্ট্র এবং শিক্ষকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। শ্রেণিকক্ষে কার্যকর পাঠদান নিশ্চিত করতে যেমন শিক্ষক, শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন, সেই সাথে অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের ভূমিকাও আছে। বিষয়গুলির মধ্যে সুষম সমন্বয় না হলে কাজটি যথাযথভাবে হবে না। শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি মনোযোগী এবং আগ্রহী হওয়া যেমন জরুরি তেমনি শিক্ষকদের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি কৌতুহল সৃষ্টি এবং নিবৃত্ত করা। কাজ দুটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর হলেও এর সাথে জড়িত শিক্ষার পরিবেশ। করা এর জন্য প্রয়োজন অভিভাবকের সার্বক্ষণিক তদারকি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শ্রেণিকক্ষ পাঠের উপযোগী করা। সেই সাথে শিক্ষার সাথে যুক্ত সকল লজিস্টিক নিশ্চিত করা। সর্বশেষ আর্থিক চাহিদা পূরণে অভিভাবক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর সরকারকে ভূমিকা নেয়ার সাপোর্ট। শিক্ষার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নে স্বাধীন বাংলাদেশে অনেকটাই পূর্ণাঙ্গ আকারে ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখি উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল। যুক্তিবাদী, নীতিবান নিজের এবং অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংকারমুক্ত, পরমসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক ও কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলাও শিক্ষার অন্যতম শর্ত। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতির উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়নে কতগুলি বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি। এর মধ্যে শিক্ষার দর্শন অন্যতম। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু কতগুলি বিষয় মুখস্থ করিয়ে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন নয়। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তন সেই সাথে সে আচরণ হবে দেশ, জাতি ও মানুষের স্বার্থে মানুষের কল্যাণের জন্য। এই জন্য শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা দরকার শিক্ষার বিষয়বস্তু কি হবে? কেন হবে এবং কিভাবে সেটা অর্জন করা সম্ভব? সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এর পর প্রয়োজন শিক্ষা নামক মৌলিক অধিকারটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন। জনগণের খাজনা ও কর নিয়ে থাকে সরকার। করেরও অর্থ থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন, স্থানীয় বিত্তশালী এবং শিক্ষা অনুযায়ী তাদেরও শিক্ষায় অর্থায়নে এগিয়ে আসা দরকার। তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ডিবিশনে সরকার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থায়ন হলে শিক্ষার সংখ্যাগত মানই শুধু নয়, গুনগত মানও বৃদ্ধি কর্রা সম্ভব। শিক্ষা এক ধরনের দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ, যেখানে থেকে একটি সময় পর কোন ধরনের বিনিয়োগ ছাড়াই সুফল পাওয়া সম্ভব। এর পর জরুরি প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। দলীয় এবং গোষ্ঠী সার্থের বিবেচনা পরিহার করে যোগ্য অভিজ্ঞ ও স্বচ্ছ এবং ডায়নামিক লোকদের শিক্ষা প্রশাসনে আনা দরকার। গভর্নিং বডি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রশাসনের সকল স্তরে। যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ লোকদের প্রয়োজন শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের উৎসাহিত করতে আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা থেকে সম্মানের জায়গাতেও গুরুত্ব দেয়া। বিত্তনির্ভর সমাজের বিপরীতে জ্ঞাননির্ভর সমাজ বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলেই শিক্ষার পরিবেশ যেমন নিশ্চিত হবে, সেই সাথে দেশের উন্নয়নে মালয়েশিয়া, চীন ও কোরিয়ার মত বাংলাদেশও হতে পারবে উন্নত রাষ্ট্র। শিক্ষার দর্শন, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের কাজে যারা নিয়োজিত থাকে, তাদের মধ্যে অন্যতম শিক্ষক সমাজ। সেই কারণেই শিক্ষক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষক সমাজ সেই গুরুদায়িত্ব পালন করবেন এমনটা আশা করাই স্বাভাবিক। সে দিক থেকে সমাজের আর ৫টি পেশা থেকে শিক্ষকতা একটি ভিন্ন পেশা, এবং এর মর্যাদাও ভিন্ন। সেক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা যতই কম হোক। বিশ্বায়নের এ যুগে আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এবং ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল বিষয়ের আলোকে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ বঞ্চিত। শিক্ষার সংখ্যাগত ও মানগত উন্নয়নে শিক্ষকদের স্বার্থবিবেচনা করা জরুরি। বিষয়টি সমাজ ও রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। শিক্ষকদের পেশার আলোকে তাদেরও বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তারা জাতি গড়ার দায়িত্ব নিয়েই এ পেশাতে এসেছেন। নিজে কম সুযোগ পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করবেন এমন মানসিকতা থাকা উচিত নয়। শিক্ষক দ্বিতীয় জন্মদাতা, বাবার সমতুল্য এবং জাতিগড়ার কারিগর। ভেজালের ভিড়ে খাটি মানের অনিশ্চয়তা থাকলেও শিক্ষকরা আজও সমাজের চোখে মর্যাদা পান। সেটি মোটেই উপেক্ষার নয়। সব কিছুতেই অর্থ মূল্যে হিসাব হবে না। মাপা যায় না। আর্থিক মূল্যে সব কিছুকে না মেপে ব্যবহারিক মূল্যে বিচার করলে মানসিক দুচিন্তা অনেকটাই লাঘব হতে পারে। এর জন্য শিক্ষকদের শুধু শিক্ষার্থীর স্যার হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলবে না। তাদেরকে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দেশ জাতি ও মানুষের স্বার্থে দাঁড়াতে হবে, সামাজিক ভূমিকা রাখতে হবে, নিজেদের মেরুদণ্ডটি সোজা করে রাখতে হবে। ব্যক্তি ও দলীয় সাথে শিক্ষক সমাজ যেন তার পেশাদারিত্বকে ত্যাগ না করে। ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকেই অনেক মতের ও পথের হতে পারে, সে জন্য কারো প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ যেমন শিক্ষকের জন্য শোভনীয় নয়, তেমনি মানসিক গুণাবলির শিক্ষা থেকে কাউকে বঞ্চিত করাও উচিৎ হবে না। নানা বঞ্চনার পরও শিক্ষক সমাজ সমাজে যেভাবে সমাদৃত সেটাই কম কিসে? নিজে বঞ্চিত হওয়ায় কারণে অন্যকে বঞ্চিত করবো এমনটা শিক্ষকেরও জন্য উচিৎ হবে না। সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করলে সমাজ ও দেশ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখবেন, হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে সেটা সম্ভব নয়, তবে ধৈর্য্য ধরতে হবে। পেশাদারিত্ব রক্ষা করে শিক্ষকদের বঞ্চনা লাঘবে সক্রিয় হতে হবে, তবে নিজ দায়িত্বকে অবহেলা করে নয়। 
নেট থেকে