সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭

আসুন ধন্যবাদ দিতে শিখি ও কৃতজ্ঞ হই

ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার চর্চা
অন্যের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও কৃতজ্ঞতার মানসিকতা পোষণ নিজের সহজতা, উদারতা ও সুস্থতার জন্যই প্রয়োজন। উপকারীর উপকার স্বীকার না করা এবং তাকে কৃতজ্ঞতা না জানানো কিংবা অন্যের নিকট নিজ ঋণের কথা স্বীকার ও প্রকাশ না করা মানসিক সংকীর্ণতা ও অনুদারতার পরিচায়ক।

যার যা প্রাপ্য, তাকে তা প্রদান ও পরিশোধ সাপেক্ষে লেনদেনে স্বচ্ছ বা পরিষ্কার থাকা নিজের মানসিক ঔদার্য ও শারীরিক সুস্থতার জন্য বিশেষ প্রয়োজন। নাহলে অন্যের কাছে যে ঋণ বা দায় নিজের অজান্তেই থেকে যায়, সে দায়ে বা ঋণে নিজকে হতে হয় জর্জরিত। অন্যকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো মানে দায় পরিশোধের সার্টিফিকেট তথা স্বস্তিলাভ।

নিজের বিবেককে যদি বলা যায় যে- আমি যার কাছ থেকে যে কর্ম, সেবা, সুযোগ-সুবিধা বা সহযোগিতা গ্রহণ করে দায়ে পড়েছি, তজ্জন্য তাকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে পেরেছি -তাহলে আপন অন্তর্জগত ভারমুক্ত হবে। পিছুটানহীন এই সহজ-সরল, স্বস্তিকর অনুভূতি মস্তিষ্কে আনন্দ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। মস্তিষ্ক থেকে সে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেহ-মনে;  যে আনন্দের আতিশয্যে শারীরিক-মানসিক জ্বালা-যন্ত্রণা, ব্যথা-বেদনা দূর এবং রোগব্যাধি প্রতিরোধের শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তৈরি হতে থাকে নিজের ভেতরে।

দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রতি পদে পদে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে এবং স্রষ্টা ও প্রকৃতি থেকে আমরা কত রকমের সার্ভিস যে গ্রহণ করে চলেছি, তার হিসাব কষতে গেলে কাগজ-কলম ফুরিয়ে যাবে।
ধরুন, সকালে ঘুম থেকে উঠে যে কাজটা দিয়ে বা যে সার্ভিসটি গ্রহণ করে দিনের যাত্রা শুরু করি.., সেই বাথ-টয়লেট সার্ভিসের সাথে কত্তগুলো মানুষ জড়িত -তা কি খেয়াল করি? সেই সার্ভিসের জন্য তাদের কাছে আমি কি ঋণী নই? কেবলই পয়সার বিনিময়ে অনুরূপ কাজ তাদেরকে আমি কি করে দেব?
 
অন্যের সেবা গ্রহণ করতে আমাদের অনেকেরই লজ্জা হয় না, অথচ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে লজ্জিত হই কিংবা কুণ্ঠিত হই; এটি হীনম্মন্যতা তথা এক ধরনের মানসিক রোগ। আমরা নিশ্চয়ই নিজকে মানসিক রোগী বা নির্বোধ বলে পরিচিত করতে চাই না। মহাকবি শেখ সাদীও বলেছেন- যার বুদ্ধি নেই, তার থেকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা আশা করো না।

যে সেবাটি যে মানুষকে আমি দিতে পারব না কিংবা যে কাজটি করার সক্ষমতা আমার নেই -সেই সেবা, সেই কাজ ঐ মানুষ থেকে গ্রহণ করা বা ভোগ করা মানে তার কাছে আমার ঋণগ্রস্ত হওয়া নয় কি? তাই অন্য অনেকের পাশাপাশি সুইপার বা ক্লিনারের কাছেও কি আমি ঋণী নই? তার বা তাদের কাছে ঋণ স্বীকার নাইবা করলাম, কিন্তু নিজের মধ্যে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার মানসিকতা এবং মানবিক গুণ তৈরি ও লালনে অসুবিধা কোথায়? সেই গুণ অর্জনে অনীহা ও ব্যর্থতা মনুষ্যত্বহীনতার পরিচায়ক নয় কী? মনুষ্যত্বহীন মানুষ অবিরাম সাফল্যের পথে এগুবে কী করে?     

টয়লেট সেরে নাস্তার টেবিলে এসে যে নাস্তা সাবাড় করি, একবারও কি ভাবি- সে নাস্তার পেছনে কতজনের গলদঘর্ম পরিশ্রম ও সেবা জড়িত? যে ভাত-রুটি, সব্জি প্রতিদিন খাবার টেবিলে আমি পেয়ে যাই, সে ভাত-সব্জি তৈরির সাথে রাখাল, চাষী, কৃষক, মজুর, দোকানি, রাধুনী, আয়া-বুয়া কতজনের শ্রম ও সেবা জড়িত? সে খাবার আমি যতটা খেলাম আর যতটা ফেলে দিলাম বা নষ্ট করলাম  (ছি! লজ্জা) -এ সবই কিন্তু তাদের কাছে আমার ঋণ।

কেবলই অর্থের বিনিময়ে এ ঋণ শোধ করার মানসিকতা কিন্তু অমানবিকতা বলে পরিগণ্য। এটি স্বার্থপরতা, ঔদ্ধত্য, গোঁড়ামি ও অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার পরিচায়ক। এত্তসব সেবা যাদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে যাচ্ছি -তাদের সবার কাছে গিয়ে ঋণ পরিশোধের বা দায় মোচনের কিংবা কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ তৈরি নাইবা করলাম; অন্তত নিজের ভেতরে কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি বা বিনয়বোধ জাগাতে সমস্যা কোথায়? এসব সেবা-সংশ্লিষ্টদের জন্য মনে মনে Wish বা শুভকামনা জানাতে সমস্যা কী? আমার ঋণ স্বীকারে ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে তাদের লাভ হোক বা না হোক -আমার দায়মোচন তথা আমার প্রশান্তি ও আমার লাভ নিশ্চিত হয়ে গেল। কারণ তাদেরকে শুভ ইচ্ছা জানানোর আকাঙ্ক্ষা আমার মস্তিষ্কে তৈরি হলে, তা মস্তিষ্ক থেকে আমারই দেহ-মনে সঞ্চারিত হয়ে তাদের উছিলায় আমার সবকিছুতে শুভ ও কল্যাণ ঘটতে থাকবে। অন্যদিকে নিজকে দায়মুক্ত, ভারমুক্ত ও ব্যালেন্সড মনে হবে। এতে আমার মানবিক গুণ তৈরি হলো, আমি উন্নত মননের স্তরে পৌঁছে গেলাম, আমি আলোকিত হলাম এবং সে আলোয় আমি সুস্থ ও সমৃদ্ধ হলাম; আমার আশপাশের মানুষদেরও ঐ আলোয় আলোকিত ও সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হল। কারণ চিন্তা ও মননের উচ্চ পর্যায়ে যারা পৌঁছাতে সক্ষম হন, তারা যা চান -তাই হয়ে যায়। স্রষ্টার নিকট তাদের চাওয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পূরণ হয়ে যায়।

কি আরাম, কি শান্তি, কি সহজ-সরল পথ এগুলো! অথচ এ সরল পথে না গিয়ে এবং নিশ্চিত শান্তি ও সমৃদ্ধি থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে নিজের স্বাস্থ্যহানি ও আয়ুক্ষয় করে চলেছি, সমাজকে করছি বিভ্রান্ত ও কলুষিত -সে ধারণা আমাদের ক’জনের বোধে আসে? যাদের বোধে আসে, তারা এ দর্শন বা নীতি কতটা মান্য করছি? অন্যদেরকে এ সত্য-সুন্দরের পথে কতখানি উদ্বুদ্ধ করছি? এরূপ দৃঢ়কণ্ঠের দাবিদার এ সমাজে পাওয়া যাবে কতজন? যদি পাওয়া না যায়, তাহলে এ সমাজ বা জাতির গন্তব্য কোথায়? কারণ এসবই আমাদের স্বাস্থ্যসুখের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ এবং জাতিগত সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্ববহ বিবেচ্য বিষয়। তাইতো কারও উপকার করার পর তিনি উপকার পেয়ে ধন্যবাদ দিক বা না দিক, উপকার গ্রহণের জন্য তাকে আমরা ধন্যবাদ দিয়ে নিজে আরো বড় হতে বাধা কোথায়? আমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস’র বিভিন্ন কর্মসূচির সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্র-যুবকদেরকে এরূপ চর্চায় আমরা উদ্বুদ্ধ করি। রবী ঠাকুরের একটি রোমান্টিক বন্দনার সাথে ক্যাম্পাস’র এ দর্শনের বেশ মিল রয়েছে।
তোমারে যা দিয়েছিনু, সে তোমারই দান
গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়।
অতীতে যাই করে থাকি না কেন, এখন থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের দর্শনে সবাই নিজ নিজ মানবিক গুণাবলী তৈরি ও বৃদ্ধির মাধ্যমে সুস্থ, নিরোগ, আলোকিত, সমৃদ্ধ জীবনের পথে পা বাড়াই। রিক্সাপুলার, ড্রাইভার, লিফটম্যান, দারোয়ান, মালি, কুলি, চাষী, মেথর, ঝাড়–দার, চাকর-চাকরানী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হই। যার কাছ থেকে যা পাই, তজ্জন্য তাকে ধন্যবাদ দেই; স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সবাই সবার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিজের অহংকার ও ঔদ্ধত্যজনিত অসুস্থতা ঝেড়ে ফেলি। নিজ  সুস্থতা ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করি, সমাজে-জাতিতে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনি।

তাছাড়া পরিবারের মধ্যেও পরস্পরকে ধন্যবাদ দেয়া এবং পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার। স্বামী-স্ত্রী,  বাবা-মা, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি -যাদের ত্যাগ ও সহযোগিতাকে আমরা Taken for granted  বলে মনে করি এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করি। এরূপ হীন মানসিকতা ঝেড়ে ফেললে পারিবারিক শান্তি বৃদ্ধি পাবে।
তাই আসুন, সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আমরা যাদের ওপর নির্ভরশীল এবং যাদের কাছে ঋণী, তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মানসিকতা তৈরি করে সুস্থ ও ভারসাম্য জীবন যাপনে অভ্যস্ত হই।
আর দেখুন না, এই আমিওতো ঋণী আপনাদের সবার কাছে -নিশিথ নিদ্রা ত্যাগ করে লেখা আমার এ কথাগুলো পড়ার জন্য। তাই এ ভবঘুরের সহজ-সরল চেতনাকে লালন করার জন্য আগাম ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন